বাংলা ভাষার সুষ্ঠু ব্যবহার হোক আগামীর প্রত্যয়
একটি দেশ তার শিল্প-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও শিক্ষার মানদণ্ডের ওপর ভর করে দাঁড়ায়। বিশ্বমানচিত্রে নিজের অবস্থান জানান দেয়। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বমানচিত্রে জায়গা করে নিলেও, তারও বহু বছর আগে থেকে বাঙালি তাদের শিল্প-সংস্কৃতির পরিচয় দিয়েছে নানাভাবে।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তান—দুটি স্বাধীন দেশে বিভক্ত হলেও, বাংলাদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান, তথা পাকিস্তানের একটি অংশ হয়ে। অতঃপর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানিরা, তথা বাঙালিরা স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ পায়। এ ইতিহাস সবারই জানা। তবে এই স্বাধীনতাযুদ্ধের সূচনা হয়েছে মূলত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা অর্জনের ৭০ বছর ও স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে দেশজুড়ে নানান আয়োজন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে এত এত আয়োজনেও মলিনতা প্রকাশ পাচ্ছে। যদি একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে বলতে চাই, সে ক্ষেত্রে অনেক বিষয় সামনে চলে আসবে। প্রথমেই উল্লেখ করা যায়, ভাষা আন্দোলনের ভাষাশহীদদের স্মরণে নির্মিত যে শহীদ মিনার, সেই শহীদ মিনার যেন এক রকম অবহেলা ও অপমানের খোরাক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কথাটি শুনতে খারাপ লাগলেও, একটু ভাবলেই উত্তর মিলবে যে ভুল বলেছি কি না।
প্রতিটি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে শহীদ মিনার। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারও রয়েছে, যেটি ঢাকা মেডিকেল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মাঝামাঝি। শহীদ মিনার যেখানেই হোক, প্রতিটি শহীদ মিনারেই একই দৃশ্য চোখে পড়ে।
ভাষার অপব্যবহারকে আরেকটি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। যেখানে পুরো বিশ্বে একমাত্র জাতি হিসেবে বাঙালিই ভাষার জন্য আন্দোলন করেছে, সেই বাঙালিই কিনা বিভিন্নভাবে নিজেদের ভাষার অপব্যবহার করছি। দেয়ালে, ফেস্টুনে, ব্যানারে ভুলে ভরা বাংলা বানান, বন্ধু কিংবা কারও সঙ্গে কথা বলতে, বার্তা পাঠাতে অহেতুক বাংলার মধ্যে ইংরেজিকে এনে নিজ ভাষাকে ছোট করা ভাষার অপব্যবহারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তা ছাড়া বর্তমানে দেখা যায়, বিভিন্ন ব্যানারে, সংগঠনের নামসহ বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়, ইংরেজিতে নামটি বড় করে লিখে তার নিচে ছোট করে বাংলায় লেখা। যেখানে উচিত, বাংলায় ওপরে বড় করে রেখে, ইংরেজিতে বাংলার নিচে তুলনামূলক ছোট অক্ষরে রাখা।
আরেকটি দুঃখজনক বিষয় হলো, শিক্ষাক্ষেত্রে নিজ ভাষাকে প্রাধান্য না দেওয়া। শিক্ষাই মূলত ভাষাকে সর্বস্তরে তুলে ধরতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানে ইংরেজিকে মুখ্য ভাষা রেখে বাংলাকে গৌণ ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু হওয়ার কথা ছিল, বাংলাকে মূল পাঠ্য রেখে ইংরেজিকে সহায়ক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা; কিন্তু আমরা তা করছি না। যে কারণে পিছিয়ে থাকছে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা।
আমাদের উচিত, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার করা। আঞ্চলিক ভাষা শুনে হাসাহাসি না করে তা সাদরে গ্রহণ করা। কারণ, আঞ্চলিক ভাষাও আমাদের মাতৃভাষারই অংশ। সব জায়গায় চেষ্টা করা উচিত শুধু বাংলা ভাষা ব্যবহার করা, নয়তো অন্য কোনো ভাষা; অর্থাৎ দুই ভাষার মিশেল যাতে না হয়। এতে দুই ভাষারই অপমান হয়, যা আমরা প্রতিনিয়তই করে আসছি। শহীদ মিনার হলো শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জায়গা, সেখানে সম্মান, শ্রদ্ধা রেখে চলাফেরা করা প্রত্যেকের উচিত। শহীদ মিনার কোনো পার্ক নয়, বিষয়টি প্রত্যেকের মনে গেঁথে রাখা উচিত। সর্বোপরি, শুধু ভাষার মাসে ভাষার প্রতি বিনয়ী না হয়ে, বছরজুড়ে ভাষাকে সুষ্ঠুভাবে লালন ও ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক কাতারে বাংলা ভাষার ব্যবহার করার মর্যাদা অর্জন করতে হবে সবাই মিলে।
লেখক: বিশাল সাহা, শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা