ফেলে আসা সোনালি কৈশোরের দিনগুলো
আমাদের প্রজন্মটা অনেক বৈচিত্র্যময়। এ প্রজন্ম যেমন দেখেছে মোবাইল ফোন ছাড়া বাংলাদেশ কিংবা জীবনে প্রথমবার নকিয়া ১১০০ চালানোর বিস্ময়কর অনুভূতি, তেমনি এই প্রযুক্তির যুগে দেখছে বিস্ময়কর সব অকল্পনীয় উদ্ভাবন। ছোটবেলায় অনেক বায়না ধরে কিনে নেওয়া ১০ টাকার খেলনা গাড়ি ভেঙে দেখা ছেলেটা হয়তো এখন টয়োটার নামকরা এমপ্লয়ি।
এখন ২০২১! কোভিড-১৯–এর ভয়ানক মহামারিতে আক্রান্ত পুরো বিশ্ব। এ সময়ে সবচেয়ে স্ট্রাগল করা তরুণ প্রজন্মটাই নব্বইয়ের দশকে কাটিয়ে এসেছে প্রযুক্তিবিহীন রঙিন একটা শৈশব। যেখানে ছিল না নেটফ্লিক্স, ভিডিও গেমস কিংবা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো ভার্চ্যুয়াল যোগাযোগ। ছিল না ঘরে বসে আইপ্যাড, ল্যাপটপ কিংবা মোবাইল ফোনের টাচস্ক্রিনে আটকে থাকা কিংবা ভিডিও গেমস খেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অযথা কাটিয়ে দেওয়ার অলস সময়।
আমাদের রঙিন একটা সময় ছিল। স্কুলে টিফিনপালানোর রোমাঞ্চ যেমন ছিল, তেমনি ২৫ টাকার একটা টেপটেনিস বল কেনার জন্য টাকা জমানোর গল্পও ছিল।
আব্বুর কাছে বার্ষিক পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ার শর্তে প্রিয় সব খেলনা কিনে নেওয়ার বায়না ছিল। অনেক পরিশ্রম আর না–পাওয়ার গল্পও ছিল। খুব ভোরে কুয়াশার মধ্যে সাইকেল নিয়ে ২ থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে স্কুলে যাওয়া হতো। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে বার্ষিক পরীক্ষা কবে শেষ হবে, এটা নিয়ে দিন গোনা হতো। এরপর ছুটির দিন। বহু প্রতীক্ষিত ছিল সেই সময়টা। একটা আলাদা আমেজ ছিল। না–পড়া সব গল্পের বই পড়ার আমেজ। ব্যাডমিন্টনের কোর্ট কেটে ১০ থেকে ২০ টাকা করে তুলে র্যাকেট আর ফেদার কিনে সারা দিন খেলতে থাকার আমেজ। এরপর রেজাল্ট নিয়ে চিন্তা আর রেজাল্টের দিনের সেই তীব্র আবেগ।
বিকেলে মাঠে খেলতে যাওয়ার পর মাগরিবের পর বাড়ি ফেরায় মার খাওয়ার শঙ্কা ছিল। এরপর প্রতি শুক্রবার রাতে বিটিভির সাদাকালো পর্দায় রাত আটটার ইংরেজি সংবাদের পর ‘আলিফ লায়লা’ কিংবা ‘হাতিম তাই’–এর রহস্য দেখার মতো রোমাঞ্চকর সন্ধ্যা ছিল।
ইট–পাথরে গড়া নগরীর বুকে আজ হারিকেনের আলোর বদলে রঙিন আলোর ঝলকানি। যেখানে রাত জাগা জোনাকিরা নেই, নেই সন্ধ্যার আগে পাখিগুলোর নীড়ে ফেরার তীব্র বাসনা। ১ টাকায় ৪টা চকলেট কিনে ৪ জন মিলে ভাগ করে খাওয়ার মতো সেই বন্ধুরা নেই।
নিত্যনতুন প্রযুক্তি আর আকাশছোঁয়া অট্টালিকায় চাপা পড়ে গেছে ছোটবেলার নিখাদ সব আবেগ আর ভালোবাসা। সোশ্যাল মিডিয়া, ট্রেন্ড আর ভালোবাসা কিংবা ভালো থাকার মিথ্যা অভিনয়ের ভিড়ে হারিয়ে গেছে আজ জীবনের সোনালি দিনগুলো।
ফিরে আসুক সেই পুরোনো বন্ধুত্বগুলো। সত্যিকারের ভালোবাসা আবার ছড়িয়ে পড়ুক পুরো পৃথিবীতে—এটাই প্রত্যাশা।
*লেখক: আরিফ হাসান, শিক্ষার্থী, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।