ফেলে আসা কৈশোর এবং একজন হুমায়ূন আহমেদ
খুব ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে বইটা দেখতাম। হলুদ হয়ে আসা জীর্ণ পাতাগুলো একসময় মূল বই থেকে ছিঁড়ে আসা শুরু করেছে। এ অবস্থাতেই প্রথমবারের মতো পড়ে ফেললাম। এরপর বুকের ভেতর কী তোলপাড়! জীবনের ছোট ছোট অনুভূতিগুলোর কী চমৎকার প্রতিফলন মিলল সেখানে। হুমায়ূন আহমেদের লেখা প্রথম উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগারে’র কথা বলছি। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল এই ‘শঙ্খনীল কারাগার’ দিয়ে।
আমাদের বাড়িতে তাঁর উপন্যাস খুব বেশি ছিল না। যেগুলো ছিল, সেগুলো পরপর কয়েক দিনের মধ্যে পড়ে ফেললাম। দুপুরবেলা চারদিক যখন একেবারে নিস্তব্ধ, তখন উপুড় হয়ে একমনে পড়েছি, ‘অন্ধকারের গান’, ‘একা একা’, ‘তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে’, ‘এই বসন্তে’, ‘সমুদ্রবিলাস’, ‘অচিনপুর’। এক গভীর মায়া লেগে আছে এ উপন্যাসগুলোজুড়ে। এদের সঙ্গে সেই যে মায়ায় জড়িয়ে পড়লাম, সময় থেকে সময়ে তা আরও বাড়ল।
প্রাণভরে হুমায়ূন পড়ার সুযোগ এল কৈশোরে। ক্যাডেট কলেজের লাইব্রেরিতে থরে থরে সাজানো হুমায়ূন আহমেদের বই, সেগুলো ছুঁয়ে দেখাও একধরনের আনন্দময় অনুভূতি। নিয়মতান্ত্রিক সেই জীবনে গল্পের বই পড়ার অঢেল সময় কখনো মিলত না। তবু সারা দিনের ফাঁকে অথবা সপ্তাহের শেষে সামান্য অবসরে, যে সময়টুকু ছিল একান্তই আমার—সেই সময়ে আমি হুমায়ূন আহমেদকে পেয়েছিলাম একান্ত আপন করে। ভরদুপুরে বিশ্রামের জন্য সামান্য সময়, বাইরে খাঁ খাঁ রোদ। আমি আমার ছোট্ট বিছানাটায় শুয়ে একমনে পড়ে চলেছি ‘রূপালী দ্বীপ’, ‘নীল অপরাজিতা’, ‘নবনী’, ‘বহুব্রীহি’, ‘ফেরা’, ‘অপেক্ষা’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘আমাদের শাদা বাড়ি’, ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’, ‘রোদনভরা এ বসন্ত’, ‘আমি এবং কয়েকটি প্রজাপতি’, ‘আজ আমি কোথাও যাব না’, ‘আজ দুপুরে তোমার নিমন্ত্রণ’, ‘পাখি আমার একলা পাখি’।
একেকটা উপন্যাসের একেক রকম স্বাদ-বিচিত্র রকম অনুভূতি অবিরাম খেলা করত মনে। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের নায়িকাদের প্রেমে পড়ে গেলাম একবারে। হিমু সিরিজের ‘রূপা’, ‘এইসব দিনরাত্রি’র নীলু, ‘কোথাও কেউ নেই’র মুনা, ‘ছায়াবীথি’র নায়লা, ‘অন্ধকারের গানে’র অলীক—আমার কৈশোরের রোমান্টিক মনের পুরোটাই চলে গেল তাদের দখলে। সঙ্গে আরেকটা বিচিত্র সমস্যাও দেখা দিল। আমার মনে হতে লাগল, আমার জন্ম হয়েছে একটা ভুল সময়ে, আরও কয়েক দশক আগে আমার পৃথিবীতে থাকা উচিত ছিল—যেমন, আশি অথবা নব্বইয়ের দশকে। তার মানে শুধু হুমায়ূন না, যে সময়টাকে তিনি তাঁর গল্পজগত সৃষ্টি করেছেন তার প্রতিও তত দিনে আমার গভীর ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে। বহুদিন পরে উডি অ্যালানের ‘Midnight in Paris’ (২০১১) ছবিতে দেখেছিলাম, ওই ছবির নায়ক গিল পেন্ডারও একই রকম মনোজাগতিক জটিলতায় ভোগে। কাজেই ‘মিডনাইট ইন প্যারিস’ও আমার একান্ত আপন হয়ে গেল।
কৈশোরে ক্যাডেট কলেজের দিনগুলোয় আমাদের পড়ার জন্য সন্ধ্যায় যে সময় নির্দিষ্ট ছিল, তখন গল্পের বই পড়া ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ডিউটি মাস্টার অনবরত হেঁটে বেড়াতেন ক্লাসরুমের করিডর দিয়ে। এদিকে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের ওপর ফিজিকস, কেমিস্ট্রি অথবা ম্যাথ বই চাপিয়ে তার নিচে নিবিষ্ট মনে আমি পড়েছি ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘মধ্যাহ্ন’, ‘মাতাল হাওয়া’, ‘বাদশাহ নামদার’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’। গল্পের বই পড়তে পড়তে এ অবস্থায় ধরা পড়লে পরদিন বিকেলে গেমস টাইমে খাকি পোশাকে তিন-চার কেজি ওজনের পুরোনো রাইফেল ঘাড়ে নিয়ে কয়েক কিলোমিটার দৌড়ানো লাগতে পারত, তবু এ উপন্যাসগুলো পড়ার মুগ্ধতার কাছে সব শাস্তির ভয় নাই হয়ে যেত।
হুমায়ূন আহমেদের কাছে আমি অনেক কারণে ঋণী। জোছনা দেখাও যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হতে পারে, তা নিয়ে তিনি ভাবিয়েছেন। বৃষ্টির সঙ্গে স্মৃতিকাতর হওয়ার সম্পর্ক দেখিয়েছেন। মাঝেমধ্যে হিমুর মতো উদাসীনতার চর্চা করার শখ জাগিয়েছেন। নীল শাড়ি কিংবা নীলু নামের মেয়েটার জন্য এক কোমল ভালোবাসার জাল বুনে দিয়েছেন হৃদয়ের গভীরে। আমার কৈশোরজুড়ে একটা অংশে একাকার হয়ে মিশে আছেন হুমায়ূন আহমেদ।
বৃষ্টিভেজা দিনে বা খাঁ খাঁ রোদ্দুরের দুপুরে সেই যে আপনমনে একের পর এক পড়েছিলাম—‘মেঘের ছায়া’, ‘মন্দ্রসপ্তক’, ‘আয়নাঘর’, ‘আশাবরী’, ‘আমার আছে জল’, ‘বাসর’, ‘সাজঘর’, ‘কৃষ্ণপক্ষ’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘সেদিন চৈত্র মাস’, ‘তেঁতুল বনে জোছনা’, ‘দিঘির জলে কার ছায়া গো’, ‘নি’, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘নির্বাসন’—সেই ফেলে আসা কৈশোরের প্রতি আমার এখনো স্মৃতিকাতরতা আর গভীর মমত্ব কাজ করে।
শুধু আমি না, একটা আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার কারণে আমার মতো শত শত কিশোর হুমায়ূন আহমেদকে যে কতটা আপন করে পেয়েছিল, সেটা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। চারপাশ নিস্তব্ধ, তেমন কোনো সাড়াশব্দ নেই। হঠাৎ করে একজন অট্টহাসি দিয়ে উঠল—দেখা গেল, সে ‘হিমু’ সিরিজের কোনো একটা বই পড়ছে। অবাক হয়ে সবাই যে তার দিকে তাকিয়েছে, সেদিকে তার নিজেরও কোনো খেয়াল নেই। সে নিবিষ্ট মনে হিমুর সঙ্গে ঢাকার রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছে, মানুষকে চমকে দিচ্ছে অথবা দিতে চাচ্ছে। এই পৃথিবী নামক ভারী জগৎকে হালকা করে দেখার এক অনন্য সুযোগ এনে দিয়েছে তাঁর এই সহজ–সাবলীল উপন্যাসগুলো।
‘দ্বিতীয় মানব’, ‘কুটুমিয়া’, ‘পারুল ও তিনটি কুকুর’ অথবা ‘পোকা’র মতো উপন্যাসগুলো অতিপ্রাকৃত বা ব্যাখ্যাতীত জগতের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণের জন্ম দিয়েছে। সেই জগতের রহস্য ভেদ করার প্রয়াস হিসেবে আবার জন্ম নিয়েছে ‘মিসির আলি’ সিরিজের ‘দেবী’, ‘নিশীথিনী’, ‘বৃহন্নলা’, ‘অনীশ’, ‘কহেন কবি কালিদাস’, ‘যখন নামিবে আঁধারে’র মতো উপন্যাসগুলো। হুমায়ূন আহমেদ শুধু একজন লেখক নয়, আমাদের কাছে তিনি ছিলেন একটা গোটা জগৎ।
তাঁর বই কখনো জোর করে পড়তে হতো না, বরং একবার শুরু করলে তা আপন গতিতেই শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেত। এই যে একনিশ্বাসে পড়ে ফেলার আনন্দ, তা আমার মতো শত শত পাঠককে প্রাথমিক পর্যায়ে বই পড়তে আগ্রহী করে তুলেছে। সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা বুনে দিয়েছে হৃদয়ের গহিনে।
সেই কৈশোর থেকেই দেখেছি—হুমায়ূনপ্রেম এ দেশে যেমন গভীর, হুমায়ূনবিরোধীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তাঁর গল্পের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্নরাই তাঁকে আক্রমণ করত সবচেয়ে বেশি। কৈশোরে যে গভীর ভালোবাসা তাঁর প্রতি আমার কাজ করত, তা থেকে হুমায়ূনবিরোধীদের ওপর আমি সেই বয়সে রীতিমতো কড়া বাক্যযুদ্ধে অবতীর্ণ হতাম। অনেকে আবার তাঁর সাহিত্য নিয়ে কোনো রকম ধারণা না রেখে, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়েই পড়ে থাকত। সেই তর্কবিতর্কের কথা ভাবলে এখন বেশ হাসি পায়। হায় রে আমার হুমায়ূনপ্রেম!
তাঁর নির্মিত সব নাটক এবং চলচ্চিত্রগুলো দেখেছি আরও পরে। পরিবারের সব সদস্য একসঙ্গে বসে প্রাণখোলা হাসি হাসতে হাসতে ‘বহুব্রীহি’, অথবা ‘আজ রবিবার’ দেখার মুহূর্তগুলো এখনো স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। নিবিষ্টচিত্তে আত্মজৈবনিক গদ্যগুলো পড়ার সময় তাঁর বিস্তীর্ণ জীবনে পরিভ্রমণও ছিল এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা।
‘শঙ্খনীল কারাগার’ দিয়ে আমার হুমায়ূন পাঠ শুরু হয়েছিল, এই উপন্যাসটার কথাই এখন বরং আরেকটু বলি। পরে আরও অনেকবার পড়েছি ‘শঙ্খনীল কারাগার’। কখনো ক্লান্তি আসেনি, বরং যখনই জীবনটা একঘেয়ে হয়ে এসেছে, দুপাতা পড়ে নিলেই হলো। হৃদয়জুড়ে একটা ফুরফুরে ভাব চলে এসেছে। বারবার মনে হয়েছে, এ তো আমার গল্প, এ তো আমাদের গল্প! গল্পের ‘খোকা’র সঙ্গে এক অন্য রকম একাত্মতাবোধ হয়েছে। বাবা, রাবেয়া, রুনু, ঝুনু, মন্টু, নীনুসহ সবাইকে মনে হয় খুব আপন, বহুদিনের চেনা। কিছু অংশ পড়তে গিয়ে আবেগে অজান্তেই চোখের কোনা ভিজে উঠেছে, আবার ক্ষণে ক্ষণে আপনমনেই হেসে উঠেছি। মধ্যবিত্তকে আবেগ এবং অনুভূতির এমন সূক্ষ্ম বর্ণনা উপন্যাসের পর উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া আর কে দিতে পেরেছে?
বর্তমানে অনেক দীক্ষিত পাঠককেই দেখি হুমায়ূন আহমেদের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে, যেন তাঁর উপন্যাস পড়ে থাকলে কিংবা কোনোটির প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ করলে মুহূর্তেই তারা পাঠক হিসেবে জাত খুইয়ে ফেলবেন। আবার প্রতিষ্ঠিত লেখকদের অনেকেই তাঁকে নিয়ে খুব চাঁছাছোলা মন্তব্য করে বসেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন সস্তা, বাজারি লেখক’, কিংবা ‘এ দেশে সিরিয়াস পাঠকগোষ্ঠী গড়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে ক্ষতি করেছেন হুমায়ূন আহমেদ’—এ জিনিসগুলো আমাকে খুব পীড়িত এবং ব্যথিত করে। নির্মম শোনালেও সত্য, আমাদের সিরিয়াস সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদকে লেখক হিসেবে ছোট চোখে দেখতে চাওয়াটা অনেকের কাছে ফ্যাশনের মতো, এতে সেই অন্য লেখক এবং পাঠকেরা নিজেদের অন্য স্তরের ভাবতে পেরে অজানা কোনো তৃপ্তি লাভ করেন।
তবে ওই অন্য স্তরে পৌঁছানোর সুযোগ বা সম্ভাবনা—কোনোটাই আমার নেই। হুমায়ূনকে অস্বীকার করতে হলে আমার গোটা কৈশোরকে অস্বীকার করতে হয়। তাই তাঁর সামান্য পাঠক হিসেবে আমি তাঁকে বহন করে চলি গভীর ভালোবাসায়, জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশের মতো লালন করি অবিরাম।
*লেখক: নাফিস সাদিক, শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ (তৃতীয় বর্ষ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।