ফেলুদার সাত সতেরো

১৯৬৫ সাল। সত্যজিৎ রায়ের বয়স তখন ৪৪। আগের বছর তার ‘চারুলতা’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছে। ওই বছর তিনি একটি ছোটগল্প লিখলেন। গল্পটি ছিল ১৩ বছরের বালকের আর তার জেঠতুতো ভাইয়ের অসাধারণ বিশ্লেষণ আর নিরূপণ দক্ষতার কাহিনি নিয়ে। যদিও এটি একটি গোয়েন্দা গল্প ছিল, কিন্তু এতে কিছুটা কমিক উপাদানও ছিল। আর প্রথাগত গোয়েন্দা গল্পের মতো অপরাধের উপাদানও বেশি ছিল না। কিন্তু বালকটির সঙ্গে তার জেঠতুতো ভাইয়ের যে অসাধারণ সাবলীল সম্পর্ক ছিল, তা বুঝতে কারও বাকি ছিল না। বালকটির নাম ছিল তপেশ রঞ্জন মিত্র ওরফে তোপশে। আর তার ২৭ বছর বয়সী ভাইটির নাম ছিল প্রদোষ চন্দ্র মিত্র ওরফে ফেলুদা। গল্পটি প্রকাশিত হয় ডিসেম্বর মাসে ‘সন্দেশ’ পত্রিকায়। আর আমাদের প্রথম ফেলুদার সঙ্গে পরিচয় হয়। গল্পটির নাম ছিল ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’। গল্পটিতে ফেলুদা একটি চিঠিতে হুমকির রহস্য সমাধান করেন।

বলা যায়, অনেকটা আকস্মিকভাবেই আবির্ভাব ফেলুদার। সত্যজিৎ রায়ের একটি লাল রঙের খেরো খাতা ছিল। খাতাটিতে তিনি তার গল্পগুলোর খসড়া লিখতেন। এ ছাড়া আরও অনেকগুলো খসড়া খাতা ছিল। কিন্তু তার কোনো খাতাতেই ১৯৬৫ সালের আগে কোথাও ফেলুদা চরিত্রের কোনো দেখা পাওয়া যায়নি। ১৯৬৫ সালে তাঁর সেই বিখ্যাত খসড়া খাতার তৃতীয় পাতায় খুব নাটকীয়ভাবে হঠাৎ করেই এই গোয়েন্দার আবির্ভাব ঘটে। এই হঠাৎ করে এসে তিনি তাঁর গোয়েন্দাগিরির জন্য অগুনতি মানুষের মন জয় করে যে বেঁচে থাকবেন বছরের পর বছর ধরে, সেটা মনে হয় কেউ সেদিন ভাবতে পারেননি। হয়তো সত্যজিৎ রায় নিজেও নন।

দক্ষিণ কলকাতার রজনী সেন রোডের ২১ নম্বর বাড়িতেই থাকতেন ফেলুদা। কাকার পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। কাকাতো ভাই ছিল তোপশে। রজনী সেন রোডের এই বাড়িতে আসার আগে তাঁরা সবাই কলকাতার তারা রোডের একটি বাড়িতে থাকতেন। আর এই ফেলুদার সব রহস্য সমাধানের সার্বক্ষণিক সহচর ছিল এই তোপশে। আর তাই সে ফেলুদার সব কাহিনির সূত্রধর৷ সে ঝরঝরে ভাষায় বর্ণনা করে যেত চমত্‍কার সব বেড়ানোর গল্প, জট পাকানো দারুণ সব রহস্য আর ফেলুদা কর্তৃক এসব রহস্যের কিনারা, ক্ষুরধার সব ভিলেনের সঙ্গে মোলাকাত এবং তাদের সঙ্গে লড়াই এই সব বিষয় নিয়ে।

গোয়েন্দাগিরির শুরুর দিকে

চিঠির রহস্য উদ্‌ঘাটনের বেশ কয়েক বছর পরের ঘটনা। তোপশে ও তার বাবার সঙ্গে ফেলুদা লক্ষ্ণৌর বড় ইমামবাড়ার কাছে বসবাসরত তাদের অ্যাডভোকেট আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যান। সে সময় ফেলুদা ব্যাংকে চাকরি করতেন। সে বেড়ানোর সময় ফেলুদা মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলের একটি ‘বাদশাহী আংটি’কে চুরির হাত থেকে বাঁচানোর পর ফেলুদার গোয়েন্দাগিরিতে মনোযোগ বাড়তে থাকে। নামডাকও হতে থাকে। সে সময় তিনি ভিজিটিং কার্ড ছাপালেন গোয়েন্দা পরিচয়ে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দিলেন। আর তখন থেকেই বিভিন্ন ধরনের রহস্য সমাধানের জন্য অনেকেই তার দ্বারস্থ হতে শুরু করলেন। এ সময় তিনি সহকারী তোপশেকে নিয়ে ‘কৈলাস চৌধুরীর পাথর’ এবং ‘শেয়াল দেবতা রহস্য’-এর সমাধান করলেন।

১৯৭০ সালের ঘটনা। এক বিয়ের অনুষ্ঠানে ‘দেশ’ ম্যাগাজিন পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক সাগরময় ঘোষের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের পরিচয় হলো। সাগরময় ঘোষ তত দিনে ফেলুদার কথা জেনে গেছেন। তিনি তাই সত্যজিৎ রায়কে অনুরোধ করলেন বড়দের উপযোগী করে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য ফেলুদার কাহিনি লিখতে। সত্যজিৎ সে সময় সাগরময় ঘোষের প্রস্তাব হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সাগরময় ঘোষ সত্যজিতের পিছু ছাড়লেন না। তাঁকে রাজি করানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি একদিন সত্যজিৎ রায়ের বিশপ লেফরয় রোডের ফ্ল্যাটে হাজির হলেন। ব্লাড প্রেশারের রোগী সাগরময় ঘোষের জন্য সত্যজিৎ রায়ের ফ্ল্যাটে ওঠার খাড়া সিঁড়িগুলো ডিঙানো বেশ কষ্টের হলেও নাছোড়বান্দা তিনি সেটাই করলেন। সত্যজিৎ এবার আর তাঁকে না করতে পারলেন না। ওই বছরই দেশ ম্যাগাজিনের শারদীয় সংখ্যায় বড়দের তথা বলা যায় সব বয়সী পাঠকের উপযোগী করে বের হলো ‘গ্যাংটকে গন্ডগোল’। গ্রীষ্মের ছুটিতে গ্যাংটকে বেড়াতে গিয়ে গন্ডগোলে পড়লেন ফেলুদা। সেটারও কিনারা করলেন শেষে।

থ্রি মাস্কেটিয়ার্স

কিছুদিন পর ফেলুদা আর তোপশের সঙ্গে যোগ দিলেন লালমোহন বাবু ওরফে জটায়ু। পেশায় লেখক। লিখতেন রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস। লিখতেন জটায়ু ছদ্মনামে। ‘সোনার কেল্লা’-তে তাকে সত্যজিত্‍ রায় নিয়ে এলেন। যোধপুর যাওয়ার সময় রেলগাড়িতে প্রথম পরিচয় হয় তাদের। সিরিয়াস উপন্যাসে তার আগমন ছিল খানিকটা কমিক রিলিফ হিসেবেই। তখন লালমোহনের মাথায় খোঁচা খোঁচা চুল, চোখে মোটা চশমা। ‘বাক্স-রহস্য’তেও তা-ই। তার ছেলেমানুষি বোকা বোকা হাবভাব, কথাবার্তার সরলতা আস্তে আস্তে ঢুকে পড়তে লাগল সিরিয়াস ফেলুদা আর সমবয়সী ছেলেদের থেকে অনেক স্মার্ট তোপশের জীবনে। লালমোহনের যাতায়াত বাড়তে থাকল রজনী সেন রোডের বাড়িটিতে। সাধারণত রোববার সকালে খোশগল্প করতে চলে আসতেন তিনি। ফেলুদা, তোপশে আর লালমোহন বাবুর বন্ধুত্ব ক্রমাগত গভীর হতে লাগল। এরপর, বোসপুকুর, বোম্বে, কিংবা হিথ্রো, একের পর এক সব রহস্য অভিযানে তিনজনে পাড়ি জমিয়েছেন একসঙ্গে৷

লালমোহন বাবুর আগমনের পর যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠল গল্পগুলো। ভ্রমণকাহিনি, রহস্য উদ্‌ঘাটনের সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে তিন অসমবয়সী বন্ধুর দৈনন্দিনতার টুকরো টুকরো ঘটনা, খুনসুটি আর নির্ভরতা। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ গল্পে মারাত্মক মগনলাল মেঘরাজ ফেলুদাকে টাকা দিয়ে হাত করতে পারল না। আর তাই জটায়ুকে ছুরির সামনে দাঁড় করিয়ে চূড়ান্ত একটা খেলা খেলেন। সেই সময় ভয়ে সাদাসিধে, ভিতু জটায়ু অজ্ঞান হয়ে যান। বন্ধুর এই অপমান সহ্য করতে পারেননি ফেলুদা। তখনই প্রতিজ্ঞা করে এর বদলা নেবেনই। আর তা না হলে গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেবেন। শেষমেশ বেশ দুর্দান্তভাবে জব্দ করলেন শয়তানটাকে। এটা কি শুধুই গণেশ উদ্ধারের জন্য? না। এর মধ্যে কোথাও যেন মিশে ছিল খানিকটা ব্যক্তিগত আক্রোশও আর প্রিয় বন্ধুর অপমানের বদলা নেওয়ার চেষ্টা।

‘গোরস্থানে সাবধান’-এ গাড়ি কিনলেন লালমোহন বাবু৷ কিনে প্রথমেই গেলেন ফেলুদার বাড়ি৷ সবচেয়ে আপন আর খাতিরের মানুষকেই তো প্রথম খুশির খবরটা দেওয়া উচিত। ফেলুদা যখন চায়ের অর্ডার দিতে যাচ্ছিল, জটায়ু আটকালেন, ‘ওটা এখন বাদ দিন; আগে চলুন একবারটি চক্কর মেরে আসি৷ আপনাকে আর তপেশবাবুকে না চড়ানো অবধি আমার ঠিক স্যাটিসফ্যাকশন হচ্ছে না। বলুন কোথায় যাবেন।’ আসলে তাদের সম্পর্কটাই এমন ছিল যে সবাই মিলে কিছু অভিজ্ঞতা ভাগ করে না নেওয়া পর্যন্ত আনন্দটাই নেই৷

লালমোহন তাদের কতটা আপন ভাবতেন তা স্বীকার করেছেন ‘এবার কাণ্ড কেদারনাথে’। একবার লালমোহন বাবুর পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে কথা হচ্ছিল। লালমোহন বাবুর কথায় তখন স্পষ্ট হয়ে যায় এই থ্রি মাসকেটিয়ার্সের সম্পর্কের বাঁধন, ‘আপন বোন একটি আছেন, দিদি, স্বামী রেলওয়েতে চাকরি করেন; ধানবাদে পোস্টেড। জ্যাঠার ছেলে নেই, তিন মেয়ে, তিনজনের স্বামীই ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। বিজয়া দশমীতে একটি করে পোস্টকার্ড—ব্যস! আসলে রক্তের সম্পর্কটা কিছুই নয়, ফেলুবাবু৷ এই যে আপনার আর তোপশের সঙ্গে আমার ইয়ে, তার সঙ্গে ব্লাড রিলেশনের কি কোনও— ?’ এই ‘ইয়ে’ বলতে লালমোহন বাবু হয়তো তাদের সম্পর্ককে আপনের চেয়েও আপন বোঝাতে চেয়েছেন।

ফেলুদা মাঝে মাঝে খোঁচা মেরে কথা বলতেন লালমোহন বাবুকে, আর লালমোহন বাবু কিন্তু তা হজম করে যেতেন হাসিমুখে। এই ফেলুদাই অনেক সময় লালমোহনের লেখা শুধরে দিতেন৷ লালমোহন বাবু তার সাহারায় শিহরণ বইটাতে উটের জল খাওয়া নিয়ে এক আজগুবি তথ্য দিলে ফেলুদা তা শুধরে দিয়েছিলেন। ‘বাক্স রহস্য’ উদ্‌ঘাটনের সময় একবার ফেলুদার সঙ্গে দেখা করার সময় লালমোহন বাবু তার একটি নতুন বই ফেলুবাবুকে উপহার দেওয়ার সময় ফেলুদা বইটি হাতে নেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এবারে আর কোনো তথ্যের গন্ডগোল নেই তো?’ লালমোহন বাবু কাহিনি বলার সময় ফেলুদা যখন এই বইতেও তথ্যের গোলমালটা ধরিয়ে দিলেন, তখন লালমোহন বাবু বেশ খুশি হয়েই বলেছিলেন এখন থেকে প্রকাশের আগে তার নতুন বই ফেলুদাকে দেখিয়ে নেবেন একবার।

এ রকম আরও হরেক রকম উদাহরণ ছড়িয়ে আছে গল্পে গল্পে। এই তিনজন অসমবয়সী বন্ধুর এ রকম মজাদার কাহিনি আর কোনো বাংলা কল্পগল্প বা উপন্যাসে আছে কি না কে জানে? আর এসবের মাঝে চলতে থাকে ফেলুদার তুখোড় গোয়েন্দাগিরি । ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এ জটিল রহস্যের কিনারা করা বা ‘টিনটোরেটোর যীশু’ কলকাতার এক জমিদার বাড়ির রেনেসাঁ যুগের একটি পেইন্টিংসকে চুরির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য হংকংয়ে যাওয়া থেমে থাকেনি তাদের। একবার কৈলাসে গেলেন অজন্তা ইলোরার মূর্তি থেকে মাথা চুরিটা ঠেকাতে। ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’ এই ঘটনা তো রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। অসম্ভব জট পাকানো ছিল কেসটা।

ভ্রমণপিয়াসী মন

অন্যান্য গোয়েন্দা কাহিনি থেকে ফেলুদার কাহিনিগুলো একটি জায়গায় এসে স্বতন্ত্রতা লাভ করেছে, তা হচ্ছে ভ্রমণের বর্ণনা। গোয়েন্দাগিরি জীবনে ৩৫টি কেসের সমাধান করেছেন ফেলুদা। তদন্তের খাতিরে কলকাতার বাইরে যেতে হয়েছে অসংখ্যবার। যেতে হয়েছে দেশের বিভিন্ন শহরে। আবার কখনো অজপাড়াগাঁয়ে কিংবা গহিন অরণ্যে। এমনকি পাড়ি দিতে হয়েছে বিদেশেও। আর রহস্যের মাঝে ভ্রমণের এসব বর্ণনায় ফেলুদার এক একটা কাহিনি হয়ে উঠত প্রাণবন্ত। টুকরো টুকরো এসব ভ্রমণবৃত্তান্ত পড়লে মনে হবে না যে এগুলো আসলে কোনো গোয়েন্দা কাহিনির অংশ।
‘সোনার কেল্লা’ কাহিনিতে ফেলুদা গেলেন রাজস্থান। রাজস্থানের ছোট্ট শহর বিকানিরে যেতে হলো তাকে প্রথমে। তোপশের বর্ণনাতে সেটা উঠে এসেছে—‘বিকানির পৌঁছলাম পৌনে বারোটায়। শহরে পৌঁছবার কিছু আগে থেকেই রাস্তা ক্রমেই চড়াই উঠেছে। এই চড়াইয়ের উপরেই পাঁচিল দিয়ে ঘেরা শহর। আর শহরের মধ্যে চোখে পড়ার মতো জিনিস হচ্ছে লালচে রঙের পাথরের তৈরি প্রকাণ্ড দুর্গ। আমাদের গাড়ি একেবারে সোজা দুর্গের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। লক্ষ করলাম, যতই কাছে যাচ্ছি ততই যেন দুর্গটাকে আরও বড় বলে মনে হচ্ছে। রাজপুতরা যে দারুণ শক্তিশালী জাত ছিল সেটা তাদের দুর্গের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়।’

জয়সালমির গিয়ে উট দেখে সেই বৃত্তান্ত দিতে গিয়ে তোপশে বলছে, ‘আর দেখছি বুনো উট। গোরু-ছাগলের মতো চরে বেড়াচ্ছে। তার কোনোটার রং দুধ দেওয়া চায়ের মতো কোনোটা আবার ব্ল্যাক কফির কাছাকাছি।’

‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ কাহিনিতে তারা থ্রি মাস্কেটিয়ার্স গেলেন মুম্বাই। তখন মুম্বাইয়ের নাম ছিল বোম্বে। সেই মুম্বাইয়ের মেরিন ড্রাইভের বর্ণনা দিয়েছে তোপশে, ‘হোটেল থেকে বেরিয়ে ডান দিকে কিছু দূর এগোলেই যাকে কেম্পস কর্নার বলে সেখানে একটা দুর্দান্ত ফ্লাইওভার রয়েছে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড তাগড়াই থামের উপর দিয়ে ব্রিজের মতো রাস্তা। তার ওপরেও ট্রাফিক, নিচেও ট্রাফিক। আমরা ব্রিজের তলা দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে গিবস রোড ধরে দক্ষিণ দিকে চলেছি। ফেলুদা ডান দিক দেখিয়ে বলল, পাহাড়ের গা দিয়ে ওটাই হ্যাঙ্গিং গার্ডেন্স যাওয়ার রাস্তা। এই পাহাড়ের নামই মালাবার হিলস।

মাইলখানেক যেতেই সমুদ্র পড়ল। এই রাস্তাটা বাঁ দিকে দিকে সোজা পুবে চলে গিয়ে গোল হয়ে ঘুরে শেষ হয়েছে সেই একেবারে দক্ষিণে, যেখানে আকাশছোঁয়া বাড়িগুলো ঝাপসা হয়ে আছে বিকেলের পড়ন্ত রোদে। ওই ধনুকের মতো রাস্তাটাই মেরিন ড্রাইভ।’
একবার তারা গেলেন কাশ্মীর। ফেলুদার ‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর’ উপন্যাসের কাহিনি কাশ্মীরেই ঘটেছে। শ্রীনগর, গুলমার্গ কিংবা খিলানমার্গ কোনোটিই বাদ পড়েনি তাদের ভ্রমণে। খিলানমার্গের সৌন্দর্যে বিমোহিত তোপশে তাই লিখেছে, ‘প্রায় দু’ঘণ্টা লাগল দু’হাজার ফুট উঠতে। আর উঠেই এক আশ্চর্য দৃশ্য আমাদের হকচকিয়ে দিল। আমরা একটা পাহাড়ের পিঠে এসে উপস্থিত হয়েছি। সেখানে মাটিতে বরফ, সামনে বরফের পাহাড় আর উল্টো দিকে ছড়িয়ে রয়েছে গাছপালা, নদী, হ্রদসমেত দিগন্ত প্রসারিত উপত্যকা। আর তারও পিছনে আকাশের গায়ে যেন খোদাই করা রয়েছে নাঙ্গা পর্বত।’
‘টিনটোরেটোর যীশু’তে তদন্তের কাজে দেশ ছেড়ে যেতে হলো হংকংয়ে। সেই হংকং-যাত্রার প্লেন ভ্রমণের কাহিনি শোনা যাক তোপশের মুখে, ‘সকালে উঠে জানালা দিয়ে চেয়ে দেখি আমরা সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে চলেছি। তারপর ক্রমে দেখা গেল জলের উপর উঁচিয়ে আছে কচ্ছপের খোলার মতো সব ছোট ছোট দ্বীপ। প্লেন নিচে নামছে বলে দ্বীপগুলো ক্রমে বড় হয়ে আসছে, আর বুঝতে পারছি তার অনেকগুলোই আসলে জলে-ডুবে-থাকা পাহাড়ের চুড়ো। সেগুলোর উপর দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ দেখলাম পাহাড়ের ঘন সবুজের উপর সাদার ছোপ। আরও কাছে আসতে আসতে সেগুলো হয়ে গেল পাহাড়ের গায়ে থরে থরে সাজানো রোদে চোখ ঝলসানো বিশাল বিশাল হাইরাইজ।’

আরেকবার নেপাল গেলেন কেসের তদন্ত করতে। সেই সঙ্গে পরিকল্পনা ছিল কিছু বেড়ানোও হবে নেপালে। নেপাল মানে মূলত কাঠমান্ডু আরকি। এই কাঠমান্ডুর নার্ভ সেন্টার দরবার স্কোয়ার দেখে লালমোহন বাবু যখন চমকে বলে উঠলেন, ‘এ কোথায় এলাম মশাই’, ফেলদা তখন বলেছিল, ‘আপাতত আপনাকে অ্যাডভাইস দিচ্ছি—চোখ-কান-সজাগ রেখে মনপ্রাণ ভরে দেখে নিন। প্রাচীন শহরের এমন চেহারা আপনি ভারতবর্ষের কোথাও পাবেন না।’

ফেলুদা লেখার সময় ভ্রমণপিয়াসী বাঙালির মন জোগাতে সত্যজিৎ রায় প্রায় সব কাহিনিতেই ফেলুদাকে নিয়ে গিয়ে ফেলেছেন ভারতের সব সেরা সেরা ট্যুরিস্ট স্পটগুলোয়। দার্জিলিং (দার্জিলিং জমজমাট), গ্যাংটক ও সিকিম (গ্যাংটকে গন্ডগোল), নেপাল (যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে), রাজস্থান (সোনার কেল্লা), পুরী (হত্যাপুরী), কাশ্মীর (ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর), ডুয়ার্স (রয়েল বেঙ্গল রহস্য), রাজরাপ্পা (ছিন্নমস্তার অভিশাপ), মুম্বাই-মাথেরন-খান্ডালা (বোম্বাইয়ের বোম্বেটে), লক্ষ্ণৌ (বাদশাহী আংটি ও শকুন্তলার কণ্ঠহার), আওরঙ্গবাদ (কৈলাসে কেলেঙ্কারি), বারানসি (জয় বাবা ফেলুনাথ এবং গোলাপি মুক্তা রহস্য), লন্ডন (লন্ডনে ফেলুদা) এবং সিমলাসহ (বাক্স রহস্য) আরও অনেক অনেক জায়গায়। মগজের জোরে করা অসম্ভব জট পাকানো সব রহস্যের সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে মসৃণ গতিতে চলেছে ফেলুদার ভ্রমণ।

কেমন ছিলেন ফেলুদা

ফেলুদা ছিলেন লম্বা, স্মার্ট একজন তরুণ। তাঁর উচ্চতা ৬ ফুট ২ ইঞ্চি। কথা বলতেন কম কিন্তু স্পষ্টবাদী ছিলেন। মাত্র ৯ বছর বয়সে মা-বাবা মারা যাওয়ায় ফেলুদা তার বাবার ছোট ভাইয়ের কাছেই মানুষ হয়েছেন। ফেলুদার বাবা জয়কৃষ্ণ মিত্র ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে গণিত ও সংস্কৃতের শিক্ষক ছিলেন। গোয়েন্দাগিরি শুরুর আগে ফেলুদাও একটি বেসরকারি অফিসে কিছুদিন চাকরি করেছেন। তার নেশা বলতে সিগারেট। সিগারেটের প্রিয় ব্র্যান্ড চারমিনার। তার ছিল বই পড়ার প্রতি প্রবল ঝোঁক। প্রচুর বই পড়া ও সাম্প্রতিক তথ্য সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ থাকা গোয়েন্দা হিসেবে পেশাগত দিক দিয়েও তাকে অনেক এগিয়ে রেখেছিল। তিনি ছিলেন সৎ এবং রসবোধও ছিল বলে বেশ। তার স্মৃতিশক্তি ছিল প্রবল আর দৃষ্টিশক্তি ছিল প্রখর। শব্দজট আর কার্ড খেলায় তিনি ছিলেন পারদর্শী। শারীরিকভাবে সবল ফেলুদার জাগতিক বিভিন্ন বিষয়ে যেমন আগ্রহ ছিল তেমনি আগ্রহ ছিল প্যারানরমাল বিষয় কিংবা কল্পবিজ্ঞানেও। ফেলুদা প্রতিদিন সকালে নিয়মিত শরীরচর্চা ও যোগব্যায়ামে অভ্যস্ত। তার ০.৩২ কল্ট-এর একটি রিভলবার ছিল। কিন্তু তিনি মূলত অসম্ভব ভালো বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণের ক্ষমতার ওপরেই যেকোনো রহস্যের সমাধানের চেষ্টা করতেন। তাই রিভলভার থেকে গুলি চালাতে ফেলুদাকে খুব কমই দেখা গেছে।

সত্যজিৎ রায় ফেলুদাকে কোনো সুপারহিরো বানানোর চেষ্টা করেননি। সাধারণ অনেকের মতোই অনেকটা ছিলেন ফেলুদা। আর তাই কাজ হাসিল করার জন্য আমরা তাকে দেখেছি চৌকিদারকে ঘুষ দিতে। দেখেছি গুন্ডাদের সঙ্গে মারামারিতে পরাস্ত হতে। কখনো কখনো কাজের মাঝে বিশ্রাম নিতে গিয়ে হালকা ঘুমিয়ে পড়তেও আমরা তাকে দেখেছি। আবার তদন্তের খাতিরে প্রয়োজনে চুরি ও করেছেন তিনি। ফেলুদার মধ্যে তাই অনেকেই নিজের ছায়া দেখতে পেতেন। সে জন্যই বোধ হয় ফেলুদাকে ধীরে ধীরে আপন করে নিয়েছিলেন সবাই। বিভিন্ন শ্রেণির পাঠককুলের কাছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ফেলুদা হয়ে উঠেছেন অসম্ভব জনপ্রিয় অমর এক চরিত্র।

ফেলুদা ও শার্লক হোমস

সত্যজিৎ রায় যদিও নিজেই বলেছিলেন যে তিনি বিশ্ববিখ্যাত আরেক গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমস থেকে প্রেরণা পেয়েছিলেন ফেলুদা চরিত্রের, কিন্তু বাস্তবে আসলে শার্লক হোমসের সঙ্গে ফেলুদার তেমন কোনো মিল নেই। শার্লক হোমস যাঁরা পড়েছেন তাঁরা হয়তো বিষয়টি বুঝতে পারবেন। শার্লক হোমসের একমাত্র সহযোগী ছিলেন ওয়াটসন। পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। শার্লক হোমস ওয়াটসনের ওপর নির্ভর করতেন খুব বেশি। অন্যদিকে তোপশে ছিল ফেলুদার চেয়ে অনেক ছোট অনেকটাই অপরিণত এক বালক। অনেকটা ফেলুদার ওপর নির্ভরশীল। ফেলুদার সহকারী আসলে তাকে বলা যায় না। ফেলুদার শিক্ষানবিশ ছিল সে। ফেলুদার সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক খুবই ভালো ছিল। অন্যদিকে হোমসের সঙ্গে পুলিশদের সম্পর্ক অনেকটা তিক্ত-মধুর ছিল। অনেক সময় প্রতিযোগিতামূলকও ছিল। অবশ্য এই পুলিশকেই মাঝেমধ্যে হোমসের দ্বারস্থ হতে হতো বিভিন্ন জটিল কেসের জট খুলতে। ফেলুদার তৃতীয় আরেকজন সহচর ছিলেন লালমোহন বাবু। যেটা হোমসের ছিল না। সত্যজিৎ নিজেও ছিলেন হোমসের ভক্ত। ফেলুদাও তা-ই।

একবার টিভিতে শার্লক হোমস দেখে ফেলুদা মুগ্ধ হয়ে তোপশেকে বলেছিলেন, ‘একেবারে বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে। হোমস আর ওয়াটসন। জানিস তোপশে—আমাদের যা কিছু শিক্ষাদীক্ষা ওই শার্লক হামসের কাছে। সব প্রাইভেট ডিটেকটিভের গুরু হচ্ছে হোমস। তাঁর সৃষ্টিকর্তা কেনান ডয়েলের জবাব নেই?’ কেসের খাতিরে তাই একবার লন্ডন যখন তিনি গিয়েছিলেন, তখন হোমসের এত বড় ভক্ত কি তার মিউজিয়াম না দেখে ফিরে আসবেন, তা কি হয়? আর সেই মিউজিয়াম ঘুরতে গিয়ে মিউজিয়ামের দরজায় দাঁড়িয়ে ফেলুদা বলেছিলেন, ‘গুরু তুমি ছিলে বলেই আমরা আছি। আজ আমার আসা সার্থক হলো।’

নিছকই কাহিনি নয়

সত্যজিৎ ফেলুদা কাহিনিকে এমনভাবে লিখেছেন যে এগুলোকে নিছক গোয়েন্দা গল্প বললে ভুল হবে। ফেলুদা কাহিনিগুলোতে রহস্যের সঙ্গে সঙ্গে আছে ভারতীয় ক্ল্যাসিকাল মিউজিক, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির কথা, আছে চলতি বাংলা ভাষায় ধাঁধার ব্যবহার। আছে মিসরীয় প্রাচীন সভ্যতার কথা, উপমহাদেশের নবাবদের কথা, লোককবিতা এমনকি ইউরোপিয়ান আর্টের ও উল্লেখসহ ইতিহাসের নানান বিষয়ের উল্লেখ। কৈলাসে কেলেঙ্কারির সমাধানের সময় ফেলুদাকে আওরঙ্গাবাদ যেতে হয়েছিল। আর সেই শহরের ইতিহাস উঠে এসেছে তোপশের বর্ণনায়, ‘আওরঙ্গাবাদ ঐতিহাসিক শহর।

আবিসিনিয়ার এক ক্রীতদাস—নাম মালিক অম্বর—ভারতবর্ষে এসে তাঁর ভাগ্য ফিরিয়ে ক্রমে আমেদনগরের রাজার প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠেন। তিনিই খাড়কে নামে একটা শহরের পত্তন করেন, যেটা আওরঙ্গজেবের আমলে নাম পালটে হয়ে যায় আওরঙ্গবাদ। মোগল আমলের চিহ্ন ছাড়াও এখানে রয়েছে প্রায় তেরোশো বছরের পুরনো আট-দশটা বৌদ্ধ গুহা, যার ভেতরে দেখবার মতো কিছু মূর্তি রয়েছে।’
আর তাই কাহিনিগুলো পড়ার সময় অন্যান্য অনেক বিষয়ে জানার আগ্রহ মনের ভেতরে জাগিয়ে তুলে। কাহিনিগুলো কেবল ভোলায় না, ভাবায়ও বটে। সোনার কেল্লার কথাই ধরি। শুরুতেই তোপশে লিখেছে, ‘ফেলুদা হাতের বইটা সশব্দে বন্ধ করে টকটক করে দুটো তুড়ি মেরে বিরাট হাই তুলে বলল, জিয়োমেট্রি।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, এতক্ষণ কি তুমি জিয়োমেট্রির বই পড়ছিলে?
বইটায় একটা খবরের কাগজের মলাট দেওয়া, তাই নামটা পড়তে পারিনি। এটা জানি যে ওটা সিধুজ্যাঠার কাছ থেকে ধার করে আনা। সিধুজ্যাঠার খুব বই কেনার বাতিক, আর বইয়ের খুব যত্ন। সবাইকে বই ধার দেন না, তবে ফেলুদাকে দেন। ফেলুদাও সিধুজ্যাঠার বই বাড়িতে এনেই আগে সেটায় একটা মলাট দিয়ে নেয়।

একটা চারমিনার ধরিয়ে পরপর দুটো ধোঁয়ার রিং ছেড়ে ফেলুদা বলল, ‘জিয়োমেট্রির বই বলে আলাদা কিছু নেই। যেকোনো বই-ই জিয়োমেট্রির বই হতে পারে, কারণ সমস্ত জীবনটাই জিয়োমেট্রি। লক্ষ করলি নিশ্চয়ই—ধোঁয়ার রিংটা যখন আমার মুখ থেকে বেরোল, তখন ওটা ছিল পারফেক্ট সার্কল। এই সার্কল জিনিসটা কীভাবে ছড়িয়ে আছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সেটা একবার ভেবে দ্যাখ। তোর নিজের শরীরে দ্যাখ। তোর চোখের, মণিটা একটা সার্কল। এই সার্কলের সাহায্যে তুই দেখতে পাচ্ছিস আকাশের চাঁদ, তারা, সূর্য। এগুলোকে ফ্ল্যাটভাবে কল্পনা করলে সার্কল, আসলে গোলক—এক-একটা সলিড বুদ্‌বুদ, অর্থাৎ জিয়োমেট্রি। সৌরজগতের গ্রহগুলো আবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে এলিপটিভ কার্ভে। এখানেও জিয়োমেট্রি; তুই যে একটু আগে জানালা দিয়ে থুক করে রাস্তায় থুতু ফেললি—অবিশ্যি ফেলা উচিত নয়—ওটা আনহাইজিনিক—নেক্সট টাইম ফেললে গাঁট্টা খাবি—ওই থুতুটা গেল। কিন্তু একটা প্যারাবোলিক কার্ভ-জিয়োমেট্রি। মাকড়সার জাল জিনিসটা ভালো করে দেখেছিস কখনো। কী জটিল জিয়োমেট্রি রয়েছে তাতে জানিস? একটা সরল চতুষ্কোণ দিয়ে শুরু হয় জাল বোনা। তারপর সেটাকে দুটো ডায়াগনাল টেনে চারটে ত্রিকোণে ভাগ করা হয়। তারপর সেই ডায়াগন্যাল দুটোর ইন্টারসেক্টিং পয়েন্ট থেকে শুরু হয় স্পাইরাল জল; আর সেটাই ক্রমশ বাড়তে বাড়তে পুরো চতুষ্কোণটাকে ছেয়ে ফেলে। ব্যাপারটা এমন তাজব যে ভাবলে কূলকিনারা পাবি না।’

জ্যামিতিকে নিয়ে কী অসাধারণ এক মনোমুগ্ধকর চিন্তা, যা কিনা একমাত্র ফেলুদার পক্ষেই সম্ভব।

নারী চরিত্রের অনুপস্থিতি

ফেলুদার অসম্ভব জনপ্রিয়তার পেছনে আরেকটি কারণ হলো তার বিভিন্ন বয়সী পাঠককুল। সাধারণত গোয়েন্দা কাহিনিতে অপরাধের বিষয় থাকে বলে তা সাধারণত বড়দের জন্যই লেখা হয়। কিন্তু সত্যজিৎ রায় ফেলুদা লিখেছিলেন অনেকটা সব বয়সী পাঠকের কথা চিন্তা করে। বিষয়টি নিয়ে সত্যজিৎ নিজেও বলেছিলেন, অল্পবয়সী পাঠকদের কথা মাথায় রেখে রহস্য গল্প লেখা মোটেও সহজ কাজ নয়, কারণ গল্পগুলোকে বেশ পরিষ্কার রাখতে হয়। বিশেষ করে অবৈধ প্রেম আর মারাত্মক অপরাধের সঙ্গে জড়িত যৌন সম্পর্কের বিষয়গুলো থেকে। আর তার এই উপলব্ধির কারণেই হয়তো ফেলুদার প্রকাশিত কাহিনিগুলো এভাবেই এগিয়েছে। অন্য গোয়েন্দা কাহিনিতে যেখানে অনেক সময় পরকীয়া প্রেম কিংবা যৌনতার বিষয় থাকে, সেখানে ফেলুদার কাহিনিতে এ সব ঘটনা না-ই একদম। প্রেম, ভালোবাসার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অপরাধ কিংবা বিকৃত মানসিকতা দ্বারা প্রভাবিত অস্বাভাবিক অপরাধ আছে এ রকম কেস ফেলুদা কখনো পাননি। আর তাই ফেলুদার কাহিনিতে নারী চরিত্রের অনুপস্থিতি ও সংক্ষিপ্ত ভূমিকার একটি কারণও এটি। তা ছাড়া আরেকটি জিনিস এখানে লক্ষণীয় যে তোপশে তার জবানিতে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরির তদন্তের সেসব ঘটনার কথা বর্ণনা করেছে, যে ঘটনাগুলোর সঙ্গে ফেলুদা তাকে জড়িয়েছে। যেসব ঘটনার মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক উপাদান ছিল কিশোর তোপশেকে ফেলুদা সেই ঘটনাগুলোর তদন্তের সঙ্গে জড়াতে দেয়নি।

ফেলুদার যেসব কাহিনিতে নারী চরিত্রের উপস্থিতি আছে তার একটি হলো ‘অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য’। এইখানে একজন নারী চরিত্র রয়েছেন মিসেস সেন। কিন্তু তার উপস্থিতি বা চরিত্র কাহিনির সঙ্গে তেমন গুরুত্বপূর্ণভাবে সেঁটে ছিল না। ওই কাহিনিতে ফেলুদা একটি কেসের তদন্তের খাতিরে বাড়ির সব সদস্যকে প্রশ্ন করতে গিয়ে বাড়ির বউমা মিসেস সেনকে ও কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিল। মিসেস সেন তখন ফেলুদাকে বলেছিলেন, ‘আমরা কিন্তু মনেপ্রাণে চাইছি যে, আপনি ব্যাপারটার একটা সুরাহা করেন।’ ফেলুদা শেষমেশ বিষয়টির সুরাহা করেছিলেন। কিন্তু গল্পে মিসেস সেনের আর কোনো ভূমিকা নেই। মিসেস সেনের উপস্থিতি বাসার মধ্যে পারিবারিক জীবনের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অন্য অনেক ক্রাইম গল্পের নারী চরিত্রের মতো তার উপস্থিতি ছিল না।

একই রকমভাবে ‘বোসপুকুরে খুনখারাপি’, ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’, ‘শকুন্তলার কণ্ঠহার’ এই কাহিনিগুলোতেও নারী চরিত্রের উপস্থিতি আছে। যদিও তাদের উপস্থিতি খুব দীর্ঘতর হয়নি। কিংবা কাহিনিতে খুব উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় থাকতেও হয়নি তাদের। শুধু এদেরকে ছাপিয়ে অনেকটাই ব্যতিক্রমী ভূমিকা নিয়েছিলেন শ্রীমতী ডলি মুনসী। এই ডলি মুনসী হচ্ছেন ‘ডা. মুনসীর ডায়েরী’ কাহিনির একমাত্র নারী চরিত্র । তিনি ছিলেন ডা. রাজেন মুনসীর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। অন্য নারী চরিত্রগুলোর মতো ওনার উপস্থিতি এই কাহিনিতে দীর্ঘতর নয় বটে। বরঞ্চ খুব সংক্ষিপ্ত তার উপস্থিতি। কিন্তু গল্পটির একমাত্র খুনের ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন তিনি। আর খুন হয়েছিলেন তার স্বামী ডা. রাজেন মুনসী। আর তার এই ভূমিকার কারণেই তিনি হয়ে উঠলেন ‘ডা. মুনসীর ডায়েরী’ গল্পের প্রধান অপরাধী। নারী হয়েও তার এই চক্রান্তের কারণে তাকে অন্যান্য ফেলুদা কাহিনিগুলোর নারী চরিত্র থেকে সম্পূর্ণ আলাদা স্থান দিয়েছে। ফেলুদার সমাধানকৃত কেসগুলোর মধ্যে ডলি বোসের সমতুল্য অপরাধী নারী চরিত্র আর একটিও নেই।

শেষের দিকে

আশির দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ফেলুদা বেশ দাপটের সঙ্গেই করে যাচ্ছিলেন বিভিন্ন কেসের কিনারা। কিন্তু ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে ফেলুদা যেন কিছুটা খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন। সম্ভবত অনেকটা অসুস্থতার দরুন এবং চিকিৎসকদের বিভিন্ন ধরনের অনুরোধ মানতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় তার ফেলুদাতে তার সেই জাদুময় পরশ সঠিকভাবে দিতে পারছিলেন না। তিনি নিজে সেটা টেরও পাচ্ছিলেন। আর ফেলুদাকে দিয়ে সেটা বলিয়েছেন ও তিনি। আর তাইতো ‘নয়ন রহস্য’-এর কিনারা করার সময় ফেলুদার মনমরা গুমরা মুখ দেখে লালমোহন বাবু এর কারণ জানতে চাইলেন, ‘মশাই, আপনাকে কদিন থেকে ম্রিয়মাণ দেখছি কেন?’ উত্তরে ফেলুদা জানালেন তোপশের লেখা শ্রীমান প্রদোষ মিত্রের কার্যকলাপে পাঠকেরা আর আগের মতো মজা পাচ্ছেন না। এই নিয়ে প্রতিদিনই চিঠি পাচ্ছেন তিনি। তিনি বললেন পাঠকেরা বলছেন, ‘ফেলু মিত্তিরের মামলা আর তেমন জমাটি হচ্ছে না, জটায়ু আর তেমন হাসাতে পারছেন না, তোপশের বিবরণ বিবর্ণ হয়ে আসছে’। লালমোহন বাবু তখন অনেকটা রেগে গিয়ে বলেছিলেন এই সব চিঠি তিনি বাস্কেটে ফেলে দেন না কেন। উত্তর ফেলুদা বলেছিলেন, ‘কারণ এইসব পাঠকই এতকাল আমাকে সাপোর্ট করেছে; এখন যদি তারা বলে যে, থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের অকাল বার্ধক্য দেখা দিয়েছে, তা হলে কথাটা আমি উড়িয়ে দিতে পারি না।’ আর তাই হয়তো ‘নয়ন রহস্য’-তে তিনি অনেকটাই তা পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। যাই হোক তত দিনে অনেক দেরিও হয়ে গিয়েছিল। পরের বছরই, ১৯৯২ সালে সত্যজিৎ রায় মারা যান। আর মারা যাওয়ার আগে তিনি ফেলুদাকে নিয়ে লিখলেন, ‘রবার্টসনের রুবি’। আর এটাই ছিল ফেলুদার সর্বশেষ কেস।

জয় বাবা ফেলুনাথ

সত্যজিৎ শুধু ফেলুদা লেখেননি, একে সেলুলয়েডের ফিতায়ও ধারণ করেছেন। বানিয়েছেন সিনেমা। তাঁর নির্মিত ফেলুদানির্ভর প্রথম চলচ্চিত্র ছিল ‘সোনার কেল্লা’। এ ছবি মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে। ফেলুদা চরিত্রে ওই ছবিতে অভিনয় করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

সোনার কেল্লা ছবিটি সে সময় কেবল জাতীয় পুরস্কার আর দর্শক জনপ্রিয়তা পায়নি, জয়সলমিরের টুরিজমের ওপর প্রভাব ফেলেছিল অনেক, যা সত্যজিৎ নিজেও কল্পনা করতে পারেননি। আজও কলকাতা থেকে ২ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রাজস্থানে গেলে হোটেল, রেস্তোরাঁ ও দোকানগুলোতে সত্যজিৎ রায়ের মালা ছোলানো ছবি, অনর্গল বাংলা বলতে পারা পর্যটক গাইড এবং দোকানদার খুঁজে পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। এমনকি মুকুলের আগের জীবনে তার বাড়ি হিসেবে যে ঘরের ধ্বংসাবশেষ দেখানো হয়েছিল ছবিটিতে, সেগুলো এখন ‘মুকুলবাড়ি’ নামে পরিচিত। ‘সোনার কেল্লা’ ছাড়া সত্যজিৎ নিজে আর মাত্র একটি ফেলুদানির্ভর ছবি তৈরি করেছিলেন, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’। এ ছবি মুক্তি পায় প্রথম ছবির পাঁচ বছর পরে, ১৯৭৯ সালে। সত্যজিৎ পরিচালিত এই ছবিতেও ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

সত্যজিতের পর ফেলুদাকে নিয়ে ছবি করেন তাঁর পুত্র সন্দীপ রায়। বেশ কয়েকটি ফেলুদা ছবি বানিয়েছেন তিনি। সেগুলি হলো, ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ (২০০৩), ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’ (২০০৭), ‘টিনটোরেটোর যীশু’ (২০০৮), ‘গোরস্থানে সাবধান’ (২০১০), ‘রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য’ (২০১১) ‘বাদশাহী আংটি’ (২০১৪) এবং ‘ডবল ফেলুদা’ (২০১৬)। এই সবগুলো ছবিতে ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সব্যসাচী চক্রবর্তী কেবল বাদশাহী আংটি ছাড়া। বাদশাহী আংটিতে ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করেন আবীর চট্টোপাধ্যায়।

টেলিভিশনে প্রথমবার ফেলুদার নির্মিত হয়েছিল হিন্দি ভাষায়। বাঙালি এই গোয়েন্দাকে হিন্দিভাষী চরিত্রে উপস্থাপনের মাধ্যমে সারা ভারতের কাছে পরিচিত করিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায় এবং তাঁর পুত্র। তাঁদের যৌথ পরিচালনায় ১৯৮৬ সালে ‘কিসসা কাঠমান্ডু কা’ (যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে) দেখানো হয়েছিল জাতীয় টেলিভিশন নেটওয়ার্কে। আর ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শশীকাপুর।

বাংলা ভাষায় টেলিভিশনে ফেলুদা সিরিজ ও পরিচালনা করেছিলেন সন্দীপ। ‘ফেলুদা ৩০’ ও ‘সত্যজিতের প্রিয় গপ্পো’ দেখানো হয়েছিল ডিডি বাংলা চ্যানেলে। ‘ফেলুদা ৩০’ শীর্ষক সিরিজে ছিল ‘বাক্স রহস্য’, ‘গোঁসাইপুর সরগরম’, ‘শেয়াল দেবতা রহস্য’, ‘বোসপুকুরে খুনখারাপি’ এবং ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’। ‘সত্যজিতের প্রিয় গপ্পো’ শীর্ষক সিরিজে দেখানো হয় ‘জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা’, ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’, ‘গোলাপী মুক্তা রহস্য’ এবং ‘অম্বর সেনের অন্তর্ধান রহস্য’।

১৯৯২ সালে আবারও বাংলা ভাষায় টেলিভিশনে ফেলুদাকে নিয়ে আসেন নাট্য পরিচালক বিভাস চক্রবর্তী। তাঁর পরিচালনায় দেখানো হয়েছিল দুটি কাহিনি, ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’ এবং ‘গোলকধাম রহস্য’। ২০০০ সালে ইটিভি বাংলা চ্যানেলে প্রদর্শিত হয় ‘ডা. মুনসীর ডায়েরী’।

কলকাতার অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, যিনি এর আগে সন্দীপ রায়ের ফেলুদা ছবিতে তোপশে চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, একটি ওয়েব সিরিজ পরিচালনা করেন ২০১৭ সালে ফেলুদাকে নিয়ে।

তিনটি গল্প (শেয়াল দেবতা রহস্য, ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা ও গোলকধাম রহস্য) নিয়ে নির্মিত সিরিজে ফেলুদা হিসেবে তিনি নিজেই অভিনয় করেন। বাংলাদেশে ২০১৯ সালে পরিচালক তৌকীর আহমেদ নির্মাণ করেন ‘নয়ন রহস্য’। ‘নয়ন রহস্য’-তে ফেলুদা হিসেবে প্রথমবারের মতো অভিনয় করেন বাংলাদেশের অভিনেতা আহমেদ রুবেল।
২০২১ সালে ওয়েব সিরিজ হিসেবে মুক্তি পেয়েছে সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ছিন্নমস্তার অভিশাপ এবং যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে। এতে ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করেছেন টোটা রায় চৌধুরী।

ফেলুদাকে নিয়ে ‘ফেলুদা: ফিফটি ইয়ারস অফ রে'স ডিটেকটিভ’ নামে একটি তথ্যচিত্রও নির্মিত হয়েছে। ফেলুদার ৫০ বছর উপলক্ষে এটি নির্মিত হয়েছে। এটির পরিচালক এবং প্রযোজক সাগ্নিক চ্যাটার্জি। সত্যজিৎ রায় সৃষ্ট কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত এই ছবিটি প্রথমে চলচ্চিত্রটি ২০১৭ সালে নিউইয়র্ক ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ও পরে ৭ জুন ২০১৯ সালে মুক্তি পায়। ওই তথ্যচিত্রে দেখা যায় যে ইংরেজি ছাড়াও ফেলুদা ওডিশা, মালয়ালম, গুজরাটি ও মারাঠি ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে।

ফেলুদা একটি কল্পিত চরিত্র। কিন্তু তাতে কী হয়েছে। তিনি তো আর বাঙালির দূরবর্তী কেউ নন। আর তাই তো এত বছরেও আমাদের ফেলুদাকে নিয়ে আগ্রহের কোনো কমতি নেই যেন। চলছে একের পর এক তাকে নিয়ে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড। এসব দেখে সত্যিই তাই বলতে ইচ্ছে করে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’।

তথ্যসূত্র:
১. ফেলুদা সমগ্র: সত্যজিৎ রায়
২. আমি আর ফেলুদা: সন্দীপ রায়
৩. বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও পত্রপত্রিকা
লেখক: ব্যাংকার।