ফিল্ড ভিজিটে একদিন

পুস্তক থেকে অর্জিত জ্ঞানকে মাঠপর্যায়ের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া এবং ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সংযোগের অংশ হিসেবে মাঠ পরিদর্শন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এক অনুষঙ্গ। ১৮ ডিসেম্বর তেমনই এক ফিল্ড ভিজিটে অংশ নেন দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি)  ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা।

সকাল আটটায় বাস। আগের রাতে ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ (সিআর) রিমাইন্ডার হিসেবে জানিয়ে দিলেন, ফিল্ড ভিজিট হিসেবে আমরা কোথায় যাচ্ছি, ড্রেসকোড কেমন হবে, কী কী পড়তে হবে, সঙ্গে কী কী নিতে হবে এবং প্রাসঙ্গিক বেশ কিছু বিষয়। হাবিপ্রবির ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ যাত্রা শুরু করে ২০১৯ সালে ৩৯ জন শিক্ষার্থী ও ৫ জন শিক্ষক নিয়ে। প্রথমবার ফিল্ড ভিজিটে যাচ্ছি সবাই লেভেল ২, ১ম সেমিস্টারের ‘জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ কোর্সের অংশ হিসেবে। আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন কোর্স টিচার মাহবুব স্যার এবং বিভাগের চেয়ারম্যান জুয়েল স্যার। সবাই বেশ উচ্ছ্বসিত সেই সঙ্গে উত্তেজিতও বটে।

প্রস্তুতি নিতে এবং সবার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বাস ছাড়ে প্রায় ৪৫ মিনিট দেরিতে। দিনাজপুরের কনকনে হাড়কাঁপানো শীত। সূর্যের দেখা মেলে না বেলা গড়িয়ে দুপুর না হলে। প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে বিভাগের সবার প্রতি সবার এবং শিক্ষকদের স্নেহাশিস হিসেবে আমরা আশীর্বাদপুষ্ট। করোনার বন্ধের কারণে আমাদের কোথাও ট্যুর বা বনভোজনে যাওয়া হয়নি। এবারই প্রথম বিভাগের সবাই একসঙ্গে কোথাও যাওয়া, তা–ও আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে...আমাদের ফিল্ড ভিজিট একপ্রকার ঘুরতে যাওয়ার বাতাস পেয়ে বসে।

যাহোক, আমাদের ফিল্ড ভিজিটের জন্য নির্ধারিত স্থান ছিল ঠাকুরগাঁওয়ের ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)। আমরা সেখানে পৌঁছালাম ১০টার দিকে। স্বাগত জানিয়ে আমাদের কনফারেন্স রুমে নেওয়া হলো। এরপর পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন, স্পিচ, স্যারদের শুভেচ্ছা বক্তব্য চলল একটানা। এর মধ্যে হালকা নাশতাও সেরে নিলাম একফাঁকে। আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল ‘লোকায়ন জীবনবৈচিত্র্য জাদুঘর’।

গ্রামের মধ্য দিয়ে চলতে থাকল আমাদের বাস এবং সে প্রতিষ্ঠানের একটি মাইক্রো। ততক্ষণে সূর্য আমাদের মাথার ওপরে, মিষ্টি রোদ দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর আমরা আসি জাদুঘরে। লোকায়ন জাদুঘর, যেমন নাম তেমনই তার গুণ। গ্রামীণ জনপদের মানুষের ব্যবহার করা মাটি ও বাঁশ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন তৈজসপত্র, বাদ্যযন্ত্র, ধাতব সামগ্রী, প্রাচীন মুদ্রা, বিভিন্ন নদ-নদী ও সাগরের পানি, বদ্ধভূমির মাটি ইত্যাদি। বেশ কিছু বিলুপ্ত এবং অধিকাংশই বিলুপ্তির পথে। এখানে আসলে দেখা মিলবে নদী গ্যালারি, আঞ্চলিক ভাষা গ্যালারি, সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী গ্যালারি, মিউজিক গ্যালারি, তৃণমূল লোকজ গ্যালারি, রবীন্দ্র মঞ্চ, মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারি ও আপাং কটেজের।

জাদুঘর ভ্রমণ শেষ, এবার মাঠে যাওয়ার পালা। প্রেমদ্বীপ প্রকল্পের আওতায় ১৯টি পরিবারকে যুক্ত করে তাদের তাঁতশিল্পে বিভিন্ন হাতের তৈরি জিনিসে প্রশিক্ষণ দেয় ইএসডিও। এরপর বদলে যায় সমতলে বাস করা ‘ওরাও’ জনগোষ্ঠীর এই গ্রামের চিত্র। শ্রমের মজুরি বৈষম্য থাকায় বাড়ির পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা কাজ করে খুব একটা সুবিধা করতে পারতেন না। তাই প্রশিক্ষণ নিয়ে বাড়ির নারীরা পাপোশ তৈরি শুরু করেন। কোথা থেকে কাঁচামাল কিনতে হবে, কোথায় বিক্রি করবে, তার সব ব্যবস্থা করে দেয় সংস্থাটি। যা বিক্রি করে নিজেদের অসচ্ছলতা ঘুচিয়েছেন নারীরা। এখন আর রোগে-শোকে কাতরাতে হয় না বাড়ির অবহেলিত সদস্যটিকে। নিজেদের মতামত রাখতে পারেন পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে। খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী এই পরিবারের সদস্যদের জীবনযাত্রায় দারুণ পরিবর্তন আসে এই প্রকল্পের আওতায়। এখন আর নিজেকে সংখ্যালঘু হিসেবে ভাবেন না তাঁরা, ভাবেন কর্মক্ষম একজন নারী, পরিবার ও সমাজের অন্যতম সদস্য হিসেবে।

তাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের কারখানা ও গ্রাম পরিদর্শন শেষে আমরা ফিরি ইএসডিওর কার্যালয়ে বেলা তিনটার দিকে। এরপর দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে আমরা প্রতিষ্ঠানটির সদস্যদের ও বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় পর্ব ও ফটোসেশন শেষ করে গাড়িতে উঠি। এভাবেই শেষ হয় আমাদের আনন্দঘন ও শিক্ষণীয় প্রথম ফিল্ড ভিজিটের। এ ভিজিটে আমরা ক্লাসে পড়ানো জেন্ডারের সঙ্গে ডেভেলপমেন্টের যে ওতপ্রোত সম্পর্ক, তা আরও একবার বুঝতে পারলাম। সমাজের বড় একটি অংশ নারী। এখনো কিছু সমাজে তাঁরা অবহেলিত ও বঞ্চিত সবকিছু থেকে। নারী এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে যে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়, তা জানতে ও বুঝতে এই ফিল্ড ভিজিট ছিল অত্যন্ত কার্যকরী। এখানে না এলে হয়তো বিষয়গুলো বই-পুস্তকে পড়েই মুখস্থ করতাম। আজ স্বচক্ষে দেখলাম সবাই। এমন ফিল্ড ভিজিট সামাজিক বিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি কোর্সেই থাকা উচিত।

পরিবর্তনশীল এ বিশ্বের গতিশীল সব বস্তু। ইন্ডাস্ট্রিজগুলোর ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে যুগোপযোগী গ্র্যাজুয়েট তৈরির মাধ্যমে বেকার ও অদক্ষ জনগোষ্ঠীর অভিশাপ ঘোচানো সম্ভব। এ জন্য তাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের, প্রফেশনালসদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আন্তঃসম্পর্ক ও মিথস্ক্রিয়া অত্যন্ত জরুরি।

* লেখক: শিক্ষার্থী, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।