প্রিয় কলামিস্টকে মিস করব
গতকাল মঙ্গলবার রাত নয়টার দিকে হঠাৎ আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু কাউসারের ফোন! কল রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গেই কানে ভেসে এল, ‘ইমরান, তোমার প্রিয় লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ আর নেই!’ আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম! এমন দুঃসংবাদ শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। অথচ একসময় সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবারই ছিল দৈনিক প্রথম আলোতে সৈয়দ আবুল মকসুদের ‘সহজিয়া কড়চা’ শিরোনামে কলাম প্রকাশের দিন। মঙ্গলবারের পত্রিকা হাতে নিয়েই সোজা সম্পাদকীয় পাতায় চলে যেতাম প্রিয় লেখকের কলাম পড়তে। আমার মতো পাঠকদের প্রিয় দিনটিতেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করলেন!
প্রখ্যাত সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদের জন্ম মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলায়। দুই বছর বয়সে মা হারান। এরপর লালিতপালিত হন বিমাতার স্নেহে। তাঁর বাবা সৈয়দ আবুল মাহমুদের কাব্য রচনার সুবাদে তৎকালীন বহুল প্রচারিত পত্রিকাগুলো বাড়িতেই রাখা হতো। সে জন্য শৈশবেই পত্রিকাগুলোর সঙ্গে গভীর পরিচয় হয় সৈয়দ আবুল মকসুদের।
সাহিত্যে অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৯৫ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন সৈয়দ আবুল মকসুদ। ৪০টিরও বেশি গ্রন্থের লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ এ ছাড়া আরও বিভিন্ন সময়ে নানান পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বিভিন্ন সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদের নিয়ে গবেষণা করেছেন। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে যেমন তাঁর গবেষণা গ্রন্থ রয়েছে, তেমনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মতো লেখকদের নিয়েও লিখেছেন বেশ কয়েকটি বই। সেসব বইয়ে তিনি নির্মোহভাবে তুলে এনেছেন তাঁদের জীবন ও কর্ম।
পরিবেশকর্মী হিসেবে সৈয়দ আবুল মকসুদ ছিলেন বরাবরই সরবকণ্ঠ। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সব কর্মকাণ্ড ও সরকারি প্রকল্পের বিরুদ্ধে তিনি যেমন সভা-সমাবেশে প্রতিবাদী থেকেছেন, তেমনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনীতে উঠে আসত দেশ রক্ষায় একজন পরিবেশবাদীর যৌক্তিক আবেদন। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা হিসেবে তিনি সুন্দরবন রক্ষা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস নিয়ে সঠিক পরিকল্পনার বিষয়ে নিয়মিত কথা বলতেন।
মানবাধিকারকর্মী হিসেবে সৈয়দ আবুল মকসুদের মতো নির্ভীক মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। বিএনপি-জোট সরকারের আমলে ক্রসফায়ার নাম দিয়ে সরকারি বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হলে সংবিধান হাতে নিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে এসে একাই আন্দোলন চালিয়েছেন যিনি, তিনিই এই আবুল মকসুদ। সেদিনের সেই একক আন্দোলনকারী সৈয়দ আবুল মকসুদ নাগরিক সমাজের জন্য আদর্শ। সুশীল সমাজের মানুষ যে কেবল মিডিয়াতেই গলা ফাটাবেন—এমন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে এসে রাজপথে তিনি আন্দোলন চালিয়েছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, সে কথা তিনি প্রায় দুই দশক ধরে শাসকগোষ্ঠীদের বলে আসছিলেন। নাগরিক অধিকারকর্মী হিসেবে সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন দৃঢ়চিত্তে এবং সাহসিকতার সঙ্গে। কিন্তু কোনো সরকারেরই তা বোধোদয় হয়নি।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়েও সদা সচেতন ছিলেন প্রিয় কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে তাঁর চমৎকার লেখনী বরাবরই পাঠককে মুগ্ধ করেছে। আমেরিকা অন্যায়ভাবে ইরাক আক্রমণ করলে তিনি ২০০৩ সালে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন। সেই প্রতিবাদকে আজীবন ধারণ করেছেন তাঁর গায়ের সেলাইবিহীন দুই টুকরো সাদা চাদর পরিধানের মাধ্যমে। এই ১৮ বছরেও তিনি তাঁর প্রতিবাদ প্রকাশে ক্লান্ত হয়ে যাননি। বুকে ধারণের পাশাপাশি পোশাকেও মার্কিন আগ্রাসনবিরোধী চেতনা প্রকাশ করেছেন আমৃত্যু।
সাহিত্যে অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৯৫ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন সৈয়দ আবুল মকসুদ। ৪০টিরও বেশি গ্রন্থের লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ এ ছাড়া আরও বিভিন্ন সময়ে নানান পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, পরিবেশকর্মী, মানবাধিকারকর্মী ও কলামিস্ট। সব পরিচয়ের মধ্যে আমার কাছে তাঁর প্রিয় পরিচয় হলো ‘কলামিস্ট’! এত প্রাঞ্জল ভাষা প্রয়োগ, উপযুক্ত শব্দচয়ন, ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত আর রসবোধের সংমিশ্রণ আর কারও কলামে আমি খুঁজে পাইনি। দিনের পর দিন এত কলাম পড়েছি তাঁর, অথচ একবারের জন্যও মনে হয়নি তিনি নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীকে সমর্থন করছেন! একজন মানুষের লেখা এতটা নির্মোহ, নিরপেক্ষ ও সত্যনিষ্ঠ হতে পারে, সেটা সৈয়দ আবুল মকসুদের পাঠক না হলে আমি বুঝতাম না। নানান অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিটি কলামে তিনি যেমন সাহসী প্রতিবাদ করেছেন, তেমনি দেখিয়েছেন ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত ও অকাট্য যুক্তি।
বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক রক্তপাত ও অপতৎপরতায় তিনি যেমন কষ্ট পেতেন ও ক্ষোভ প্রকাশ করতেন, তেমনি সুন্দরের প্রশংসায়ও ছিলেন অকৃপণ। অনেকেই তাদের দর্শনে কেবল সরকারগুলোর কুকীর্তিই দেখেন। কিন্তু সৈয়দ আবুল মকসুদ সত্যের বন্দনায় সমান আন্তরিক ছিলেন। অন্যায়-অসংগতি প্রকাশে তিনি আওয়ামী লীগ-বিএনপি, বাম-ডান পরোয়া করতেন না। এ জন্যই তাঁকে হয়তো যোগ্য সম্মান দিতে দেখা যায়নি কোনো দল থেকেই, কোনো সরকার থেকেই। কারণ, সম্মান পেতে আজকাল কর্ম মুখ্য নয়, মুখ্য হলো চাটুকারিতা। কিন্তু সেই চাটুকারিতাই তিনি পারতেন না!
অন্যায়ের সঙ্গে সৈয়দ আবুল মকসুদ ছিলেন আপসহীন। ২০০৪ সালের ১ মার্চ হুমায়ুন আজাদের ওপর সাম্প্রদায়িক শক্তির চাপাতির নির্মম আঘাত আসলে তিনি সহজিয়া কড়চায় ‘হুমায়ুন আজাদের ওপর আঘাত-ফ্যাসিবাদের নগ্ন রূপ’ শিরোনামে কলাম লিখলেন। এতে তৎকালীন সরকার তাঁকে এ ধরনের লেখালেখি না করার জন্য সতর্ক করে। নিজের মত ও সত্য প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হতে দেখে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার উপপ্রধান বার্তা সম্পাদক পদ থেকে ইস্তফা দেন। তবু তাঁর নাগরিক অধিকারের দাবি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার দর্শনের সঙ্গে আপস করেননি।
আপাদমস্তক একজন মানবতাবাদী ও নিষ্কলঙ্ক মানুষ সৈয়দ আবুল মকসুদের কলামগুলোয় শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ও দর্শনের সুন্দরতম প্রকাশ ঘটত। সেসব লেখালেখিতে মুগ্ধ হতেন হাজারো পাঠক। তাঁর সেই হাজারো পাঠকের ভিড়ে আমি এক ক্ষুদ্র ভক্ত!
৭৫ বছরের নাতিদীর্ঘ জীবনে সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলাদেশের সাহিত্য, গবেষণা, লেখালেখি ও সাংবাদিকতার অঙ্গনে রেখে গেলেন বিরল প্রতিভার অত্যুজ্জ্বল স্বাক্ষর। তাঁর মতো নির্ভীক, দলনিরপেক্ষ প্রতিবাদী কণ্ঠকে ভীষণ রকমের মিস করবে আমার মতো হাজার হাজার পাঠক।
২০১২ সালে মাধ্যমিক পাসের পর সরকারি বিজ্ঞান কলেজে ভর্তি হই। কলেজ হোস্টেলে ওঠার আগে উত্তরায় বড় ভাই সেলিম রেজার সঙ্গে মেসে থাকতাম। একদিন সেলিম ভাই আমাকে সৈয়দ আবুল মকসুদের কলাম পড়ার পরামর্শ দেন। সেই যে আমি আমার প্রিয় কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদের সন্ধান পেয়েছিলাম! তাঁকে পাঠের মাধ্যমেই আস্তে আস্তে সব পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতা আমার ভীষণ আপন হয়ে ওঠে। কলেজ হোস্টেলে রাখা শীর্ষস্থানীয় পাঁচটি পত্রিকার প্রতিটির সম্পাদকীয় পাতা হয়ে ওঠে আমার প্রতিদিনের অতি আপন। তবে দৈনিক প্রথম আলোর ‘সহজিয়া কড়চা’ আর ‘বাঘা তেঁতুল’ কলামের জন্য আমি যেন ছটফট করতাম! অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম কখন পাব প্রিয় কলামিস্টের লেখা। পত্রিকা পেয়েই সম্পাদকীয় পাতায় প্রিয় লেখকের লেখা যেন এক নিশ্বাসে পড়ে নিতাম! সেই লেখাগুলো নিজে পড়ার পর উদয়, আকাশের মতো আরও কয়েকজন পত্রিকাপাঠক কলেজবন্ধুর সঙ্গে সেই লেখার নানান দিক নিয়ে বিশ্লেষণী আড্ডা শুরু করতাম! সৈয়দ আবুল মকসুদের এতই ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে কলেজ হোস্টেলের বন্ধুরা লেখকের সঙ্গে আমার নাম মিলিয়ে খ্যাপাত! সেই সময়ে তিনি হঠাৎ আমার অনুপ্রেরণা হয়ে গেলেন! নিয়মিত পত্রিকা পাঠের পর ২০১৬ সালে টুকটাক লেখালেখি শুরু করলাম ফেসবুকে। সীমিতসংখ্যক পাঠকের প্রশংসাও পাওয়া শুরু হলো। কয়েক বছর পর দেশের প্রথমসারির কয়েকটি বাংলা দৈনিকে আমার বিভিন্ন কলাম প্রকাশিত হলো। ইংরেজি পত্রিকায়ও লেখা শুরু করেছিলাম। তারপর লেখালেখি থেকে আচমকা বিরতিতে যাই!
লেখালেখিতে প্রায় আট মাস বিরতির পর হঠাৎ আজ প্রিয় কলামিস্ট, আমার লেখালেখিতে ভালোবাসা সৃষ্টিকারী লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদের মহাপ্রয়াণ ভীষণভাবে আলোড়িত করল। ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখটি যেন আমার চেতনার আকাশে নক্ষত্রচ্যুতির দিন। বাংলাদেশের আকাশ থেকে পতন ঘটল তারকাসদৃশ একজন জাগ্রত বিবেক। কলাম লেখায় আমার অনুপ্রেরণা সৈয়দ আবুল মকসুদের স্মৃতির প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও আন্তরিক ভালোবাসা প্রকাশ করছি।
৭৫ বছরের নাতিদীর্ঘ জীবনে সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলাদেশের সাহিত্য, গবেষণা, লেখালেখি ও সাংবাদিকতার অঙ্গনে রেখে গেলেন বিরল প্রতিভার অত্যুজ্জ্বল স্বাক্ষর। তাঁর মতো নির্ভীক, দলনিরপেক্ষ প্রতিবাদী কণ্ঠকে ভীষণ রকমের মিস করবে আমার মতো হাজার হাজার পাঠক। এমন শিল্পমনা ও সৃজনশীল মানুষের তুলনা হয় না! বিদায় আমার প্রিয় কলামিস্ট, বিদায় আমার অনুপ্রেরণা! মহান স্রষ্টার দয়া ও অনুগ্রহে পরজীবনে তুমি শান্তিতে থেকো। আর তোমার আদর্শ যেন আমাদের মতো পথহারা বাঙালির পাথেয় হয়ে সূর্যের মতো আলো দেয় আমৃত্যু—এ প্রত্যাশা করছি।
*লেখক: মো. ইমরান হোসেন, গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট