প্রিয় কবি সুকান্ত
স্কুলে পড়ার সময়ে থেকে কবি সুকান্ত হতে চেয়েছিলাম। তাঁর কবিতা, চিঠি পড়ে একেবার মন্ত্রের মতো মুগ্ধ। মিশন স্কুলের পড়ার সময়ে কবিতা লেখার চেষ্টা শুরু। আসলে তখন সেগুলো কবিতা বলতে যা বোঝায়, তা কিছুই হতে না। শুধু লেখার জন্য প্রয়াস। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুকান্তের কবিতা অনুসরণ করে লেখা। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন আমার চাচা সুলতান মাহমুদ আমাকে ‘সুকান্ত কবিতা সমগ্র’ বইটা উপহার দিলেন। এতটা আবেগঘন হয়ে গেলাম যে আর দেরি করতে পারিনি। কবিতাগুলো পড়তে শুরু করি। প্রতিটি কবিতা যেন আমাকে নতুন করে আলোড়িত করতে লাগে। মনে হতে লাগে, এ যে আমারই কথা, আমারই জীবনসংগ্রাম। গ্রামের মধ্যে একজন নিভৃতচারী মানুষ আমি। কথাবার্তার খুব কম বলতাম। বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতে ভালো লাগত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সাহিত্যের পাতাগুলো ছিল আমার প্রিয়। কবি সুকান্তের গালে হাত দেওয়া ছবিটা পেপার থেকে কেটে সাদা কাগজে আঠা দিয়ে ঘরে টাঙিয়ে রাখতাম। তখন আমাদের ইটের ঘর ছিল না। বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘরের দেয়াল।
সেই সময়ের আমার লেখা খাতা, বইপত্রের মধ্যে তিনটি নাম সর্ব সময়ে লিখে রাখতাম। রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত। কবির হওয়ার স্বপ্ন বুনতে থাকি। ‘একটি মোরগের কাহিনী’ কবিতা পড়ে আমি একটি এমন কবিতা লিখে ফেললাম। তারপর কবিতার প্রভাব পড়তে লাগে। বিপ্লবী চিন্তাগুলো মনে ভেতরে তাড়া দিতে লাগত। মনে হতে আমিও বেশি দিন বাঁচব না। সুকান্ত মতো একুশে বছরে চলে যাব। এমনটা মাথায় মধ্যে ঘুরপাক করত। দেশের জন্য, সমাজের জন্য কিছু করতে হবে। কবিতা লিখতে হবে। তারপর অকবিতা প্রতিদিনে এক-দুইটা করে লিখে রাখতাম। আর চাচাকে দেখাতাম। চাচা তো আমাকে একবিংশের এক ‘উদীয়মান’ কবি হিসেবে বলতে শুরু করল।
সুকান্তের কবিতা যেমনি ভক্ত ছিল। তাঁর চেয়ে বেশি ভক্ত হয়ে উঠি তাঁর দুর্দান্ত চিঠিগুলো। প্রতিটি চিঠিতে তার সুখ-দুঃখ, স্বপ্নের কথা উল্লেখ্য থাকত। বন্ধু কবি অরুণাচল বসুকে লেখা চিঠিগুলো কী সাবলীলভাবে লেখা। ছিল মান-অভিমানে চিত্র। ভালোবাসা, ক্ষমা, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, জীবনে ক্লান্তির কথা, নতুন লেখার কথা—কত কিছু। উল্লেখ করা যেতে পারে—
‘অরণ
তোর অতি নিরীহ চিঠিখানা পেয়ে তোকে ক্ষমা করতেই হলো, কিন্তু তোর অতিরিক্ত বিনয় আমাকে আনন্দ দিলো এই জন্যে যে, ক্ষমাটা তোর কাছ থেকে আমারই প্রাপ্য কারণ তোর আগের “ডাক-বাহিত” চিঠিটার জবাব আমারই আগে জবাব দেওয়া উচিত ছিলো। যাই হোক, উল্টো আমাকেই দেখছি ক্ষমা করতে হলো। তোর চিঠিটা কাল পেয়েছি, কিন্তু পড়লুম আজকে সকালে, কারণ পরে ব্যক্ত করছি।...’
এমন সব চিঠি। অরুণাচলকে লেখা ৩২ নম্বর চিঠির এক অংশে ছিল—
‘কাল মেজবৌদি-মাসিমাকে নিয়ে মেজদা এসেছিল। চলে যাবার পর বড় মন খারাপ হয়ে গেল। বাস্তবিক শ্যামবাজারের ঐ পরিবেশ ছেড়ে এসে রীতিমত কষ্ট পাচ্ছি। তুই কি এখনো দাঙ্গার অবরোধের মধ্যে আছিস? না কলকাতায় যাতায়াত করতে পারছিস?’
আজ বিপ্লবের কবি, রাজনীতিসচেতন কবি, সংগঠক সুকান্ত ভট্টাচার্যের ৭৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। কবি ১৯৪৭ সালের আজের দিনে যক্ষ্মারোগের কাছে জীবনযুদ্ধে হেরে যান। কিন্তু তাঁর লেখনী আমাদের আজীবন শক্তি, প্রেরণা হিসেবে থাকবে। তাঁর তীক্ষ্ণতর কলমের শক্তি তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে চিরকাল। কবিকে বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: আবু সাঈদ, কবি ও সংগঠক