প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্র যেখানে হওয়া উচিত

এনটিআরসিএ

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে ৪৫ হাজার শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা আগামী মাসে অনুষ্ঠিত হবে। প্রাথমিকের ইতিহাসে এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। এসব পদে আবেদন করেছেন ১৩ লাখ ৯ হাজার ৪৬১ জন প্রার্থী। সে হিসাবে ১টি পদের জন্য প্রতিযোগিতা হবে ২৯ জন প্রার্থীর।

২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর অনলাইনে আবেদন শুরু হয়। করোনার কারণে এখন পর্যন্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করছেন লাখ লাখ শিক্ষার্থী। ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরীক্ষার তারিখ নিয়ে অনেক গুজব শুরু হলে এসব থেকে চাকরিপ্রার্থীদের সতর্ক থাকতে বলেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের নিয়োগ পরীক্ষার তারিখ এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।’

তারিখ নিয়ে গুজব শেষ হতে না হতে আবার শুরু হয়েছে পরীক্ষার কেন্দ্র নিয়ে আলোচনা–সমালোচনা। ১৩ লাখ প্রার্থীর এই পরীক্ষা অনেকেই চান নিজ জেলা শহরে হোক। অনেকেই আবার দুর্নীতিমুক্তভাবে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার জন্য ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হোক, এটা চান। পরীক্ষা কোথায় অনুষ্ঠিত হবে, এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত কিছু জানায়নি।

বিভিন্ন বিভাগ থেকে আবেদনের তালিকা

১. ঢাকা বিভাগে—২ লাখ ৪০ হাজার ৬১৯
২. রাজশাহী বিভাগে—২ লাখ ১০ হাজার ৪৩০
৩. চট্টগ্রাম বিভাগে—১ লাখ ৯৯ হাজার ২৩৬
৪. রংপুর বিভাগে-১ লাখ ৯৬ হাজার ১৬৬
৫. খুলনা বিভাগে—১ লাখ ৭৮ হাজার ৮০৩
৬. ময়মনসিংহ বিভাগে—১ লাখ ১২ হাজার ২৫৬
৭. বরিশাল বিভাগে—১ লাখ ৯ হাজার ৩৪৪
৮. সিলেট বিভাগে—৬২ হাজার ৬০৭
সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়েছে ঢাকা বিভাগে এবং সবচেয়ে কম আবেদন পড়েছে সিলেট বিভাগে। আগের বেশ কয়টি পরীক্ষা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পরীক্ষা নিজ নিজ জেলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এতে বেশ কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো পরীক্ষা স্বচ্ছ না হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

পরীক্ষা জেলা শহরে হলে মূলত যে সমস্যা হয়, তা হলো—

১. পরীক্ষাকেন্দ্র আগে থেকে বুক করা।
২. প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুযোগ।
৩. পরীক্ষাকেন্দ্রে অতিরিক্ত সুবিধা।
৪. ডিভাইস নিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার প্রবণতা বাড়ে।
৫. অসাধু চক্রের দৌরাত্ম্য বাড়ে।
৬. একাধিক দালাল চক্র সক্রিয় হয়।
৭. নিয়োগ–বাণিজ্য বেড়ে যায়।

আগের পরীক্ষাগুলোয় অনেক চাকরিপ্রত্যাশী দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে পরীক্ষায় আগের রাতেই প্রশ্নপত্র পেয়ে যান। সেই প্রশ্নপত্র আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই আবার একাধিকজনের কাছ থেকে টাকা নেয় চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। অন্যান্য চাকরির পরীক্ষার তুলনায় প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার জন্য অসাধু লেনদেন সবচেয়ে বেশি হয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, টাকার অঙ্কটা একেকজন প্রার্থীর জন্য পাঁচ থেকে সাত লাখ পর্যন্ত হয়। তাই পরীক্ষা নিজ জেলায় হলে কেন্দ্রে দায়িত্বে থাকা শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অতিরিক্ত সুবিধা আদায় করে নেওয়া হয় বিভিন্নভাবে। যেহেতু প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা হয় শুধু প্রিলিমিনারি ও ভাইভা, তাই পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোকে প্রাথমিকভাবে টার্গেট করে অসাধু চক্র। এরপর আগের রাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস তো আছেই।

অন্যদিকে, পরীক্ষা ঢাকায় বা বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে হলে প্রশ্নপত্র ফাঁস, কেন্দ্র থেকে বাড়তি সুযোগের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। পরীক্ষা স্বচ্ছভাবে নেওয়ার জন্য অনেকেই ইতিমধ্যে মানববন্ধনও করেছেন যেন পরীক্ষা ঢাকায় হয়। অভিযোগ রয়েছে, কিছু অসাধু চক্র পরীক্ষা যেন নিজ নিজ জেলা শহরে হয়—এ জন্য পরীক্ষার্থীদের দিয়ে পাল্টা মানববন্ধন করাচ্ছে। মেধাবী শিক্ষককে একটি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রাথমিক হাতিয়ার হিসেবে ধরা হয়। এখানে যদি কেউ দুর্নীতি করে চাকরি করেন, তাহলে মেধাশূন্য জাতি দেখতে বেশি দিন আর লাগবে না। কেউ মানুক আর না–ই মানুক, অতীতে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও কেন্দ্রে বাড়তি সুযোগ নেওয়ার অভিযোগ আছে। আর প্রশ্নপত্র ফাঁসের চক্রটি সব সময় সক্রিয়। চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায়। এ ব্যাপারে কোনো তদন্তও হয় না, নেওয়া হয় না কোনো পদক্ষেপ।

তাই এর ভালো সমাধান এখন সময়ের দাবি। বিসিএসসহ বিভিন্ন নন-ক্যাডার পরীক্ষা পিএসসি যেমন খুব ভালোভাবে স্বচ্ছভাবে নিচ্ছে, ঠিক তেমনি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষাও স্বচ্ছভাবে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। প্রয়োজনে পিএসসির অধীন এ পরীক্ষা হলে আরও ভালো হয় বলে অনেকেই মনে করেন।

শিক্ষার মান বাড়াতে স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত ও নিরপেক্ষ একটি পরীক্ষা হোক, এটাই সবাই চাই। পরীক্ষাপদ্ধতির কিছু সংস্কার করে দ্রুত পরীক্ষার আয়োজন করা দরকার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। শিক্ষার মান আরও কীভাবে বাড়ানো যায়, এই বিষয়ও ভেবে দেখা দরকার। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নত হলে একটি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বেসিক উন্নত হয়। তারাই একদিন আমাদের দেশ পরিচালনা করবেন। তাই সঠিক দক্ষ মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ এখন সময়ের দাবি।

লেখক: আবদুস সাত্তার, লেখক ও প্রযুক্তিবিদ।