‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামের যথার্থতা যেন ঠিক থাকে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: সংগৃহীত

নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, সৈয়দ নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী ও শেরেবাংলা এ কে এম ফজলুল হকের মতো পূর্ববাংলার কয়েকজন সূর্যসন্তানদের অজস্র সংগ্রাম, চতুর্মুখী বাধা-প্রতিবন্ধকতা এবং ইংরেজদের সঙ্গে একধরনের দর-কষাকষির ফলই হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২০ সালে ভারতীয় আইনসভায় পাস করা ‘দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নম্বর-১৩) ১৯২০–ই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি। যার বাস্তবায়ন হয়েছিল ১৯২১ সালের ১ জুলাই।

প্রতিষ্ঠার পর স্বল্প পরিসরে কার্যক্রম শুরু হলেও ধীরে ধীরে বিভিন্ন বিভাগ, অনুষদ, ইনস্টিটিউট ও একাডেমিক ভবনসহ সার্বিকভাবে এর কার্যক্রমের পরিধি বৃদ্ধি পেয়ে এ পর্যন্ত এসেছে এবং লাখ লাখ মানুষ এখান থেকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। যেগুলো থেকে শিক্ষার্থীসহ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সর্বস্তরের জনসাধারণ উপকৃত হচ্ছে। এখানকার ছাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বুদ্ধদেব বসুর মতো হাজারো শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানীরা বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন বা এখনো অনেকেই করে যাচ্ছেন।

মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়াটা এ অঞ্চলের মানুষের কাছে যেন অধরা এক স্বপ্নের বাস্তবায়ন। কারণ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৫৪–এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২–এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৪–এর আইয়ুব ও মোনেমবিরোধী আন্দোলন, ৬৬–এর ৬ দফা, ৬৯–এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০–এর নির্বাচন, ৭১–এর মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সাধারণ মানুষের স্বার্থসংবলিত সব ঘটনাবলি ও বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে রয়েছে এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের গভীর সম্পর্ক।

পুরোনো কার্জন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ছবি: সংগৃহীত

এভাবে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাংলাদেশের সব ক্রান্তিলগ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছায়ার মতো দেশের পাশে দাঁড়িয়ে, সব অন্যায় ও অসংগতি মোকাবিলার চেষ্টা করেছে এবং দেশ ও জাতির উন্নয়ন আর অধিকারের কথা বলেছে। বাংলাদেশের প্রতিটি ঐতিহাসিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের প্রতিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রেখেছে অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর। প্রতিনিয়ত তৈরি করেছে স্বর্ণোজ্জ্বল ও অতুলনীয় ইতিহাস। তা ছাড়া একুশ শতকেও এটি দেশের স্বার্থে যখন যে আন্দোলন বা চাহিদার প্রয়োজন হয়েছে, সেই চাহিদাই পূর্ণ করার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষের অধিকার রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মপরিধির ওপর ভিত্তি করেই হয়তো–বা বলা হয় যে সাধারণত একটি দেশ তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানই জন্ম দিয়েছে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের।

উল্লেখ্য, প্রথম দিকে শিক্ষার উচ্চ মান বজায় রাখতে এর ছাত্র-শিক্ষকেরা ছিলেন দৃঢ় প্রত্যয়ী এবং এর সিলেবাস প্রণীত হয়েছিল তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের অক্সব্রিজ শিক্ষাব্যবস্থার অনুসরণে। আর বিভিন্ন বৃত্তিধারী ও বিজ্ঞানীদের দ্বারা কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কারণে ক্রমেই দেশে-বিদেশে ইতিবাচক যশ-খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তা ছাড়া ঐতিহাসিক কার্জন হলের নকশা অনেকটা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির আদলে করা হয়েছিল। এ রকম বেশ কয়েকটি কারণে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একসময় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে প্রতিষ্ঠার শতবর্ষে পা দিলেও বেশ কিছু সমস্যায় জর্জরিত এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ‘বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ এ রকম শিরোনাম আমাদের প্রায়ই দেখতে হয়, যা সত্যি উদ্বেগজনক। যদি আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কিছু দিকে লক্ষ করি তাহলে আবাসন–সংকট, সন্ধ্যাকালীন বাণিজ্যিক কোর্স, গবেষণা খাতের বাজেট স্বল্পতা, ক্যানটিনগুলোতে খাবারের নিম্ন মান এবং হলগুলোতে অছাত্রদের সরব উপস্থিতিসহ বহু সমস্যাই খুঁজে পাওয়া যাবে, যা মূলত প্রাচ্যের অক্সফোর্ড থেকে আশা করা যায় না। এ রকম বিভিন্ন কারণে অনেকেই আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা নিয়ে আপত্তি করার সাহস পাচ্ছেন। এ জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর পূর্তিতে দাবি রাখতে চাই যে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এ রকম সব ধরনের সমস্যা নিরূপণ করে তা সমাধান করার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কর্মসূচি দ্রুত গ্রহণ করতে হবে। আরেকটা দাবি অবশ্যই থাকবে তা হলো, সার্বিক দিক থেকেই ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামের যথার্থতা যেন ঠিক থাকে।

*লেখক: মো. জাফর আলী, শিক্ষার্থী, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।