প্রযুক্তির বেড়াজালে শিশুরা: মুক্তি মিলবে কবে?

ছবি: সংগৃহীত

কথায় আছে, আজকের শিশু আগামী দিনে জাতির কর্ণধার। দেশ, সমাজ ও জাতি গঠনে একেকজন যোগ্য উত্তরসূরি। কিন্তু এই আগামীর কর্ণধারদের আজকের দিনে আমরা ভুল পথে পরিচালনা করছি। তাদের আটকে দিচ্ছি প্রযুক্তির বেড়াজালে। দীর্ঘ ১৫/১৬ মাস ধরে করোনার জন্য ঘরবন্দী হয়ে আছি আমরা সবাই। শিশুরাও আটকে গেছে চার দেয়ালের ভেতর। বাইরে যেতে পারছে না তারা। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, যে বয়সে শিশুদের ছোটাছুটি, খেলাধুলা ও দৌড়াদৌড়ি করে বেড়ে ওঠার কথা, সে বয়সে তারা চার দেয়ালে বন্দী হয়ে আতঙ্কে সময় পার করছে। স্কুলের ছুটি ও পরিবারের বড়দের কর্মব্যস্ততায় দিন দিন একা হয়ে পড়ছে শিশুরা। আর এই একাকিত্ব ঘোচাতে এবং অনলাইননির্ভর পড়াশোনা হওয়ায়, আমরা আজ তাদের হাতে তুলে দিচ্ছি স্মার্টফোন, ট্যাব বা ল্যাপটপ/ কম্পিউটার। ফলে শিশুদের এই ঘরবন্দী জীবনে নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠছে স্মার্টফোন, ট্যাব বা ল্যাপটপ।

তা ছাড়া একটি বিষয় লক্ষণীয় যে অভিভাবকেরা শিশুদের শান্ত রাখার লক্ষ্যে তাদের হাতে তুলে দেয় স্মার্টফোন বা ট্যাব। গান, কার্টুন বা মজার ভিডিও চালিয়ে তাদের শান্ত রাখার চেষ্টা করে। আসলে কি কাজটি ঠিক? মোটেই না, বরং এটি শিশুদের জন্য নানাবিধ ক্ষতির কারণ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিশুদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেওয়ার মানে তাদের হাতে এক বোতল মদ কিংবা এক গ্রাম কোকেন তুলে দেওয়া। কারণ, স্মার্টফোনের আসক্তি মাদকাসক্তির মতোই বিপজ্জনক। দুই মিনিট স্থায়ী একটি মুঠোফোন কল শিশুদের মস্তিষ্কে হাইপার অ্যাক্টিভিটি সৃষ্টি করে, যা কিনা পরবর্তী এক ঘণ্টা তাদের মস্তিষ্কে বিরাজ করে।

ফাইল ছবি

বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, স্ক্রিনের রেডিয়েশন মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, বিশেষত শিশুদের জন্য বেশি মারাত্মক ক্ষতিকর যা কিনা তাদের মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত করে। দীর্ঘ সময় প্রযুক্তি ব্যবহারে হৃৎপিণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ে, হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বেড়ে যায় দ্বিগুণ। ব্যবহারকারীর স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, রক্তের চাপ বেড়ে যায়, দেহ ধীরে ধীরে ক্লান্ত ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে, এমনকি নিয়মিত ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটায়। তাহলে আমরা কি শিশুদের হাতে প্রযুক্তি দিয়ে এই সমস্যাগুলোর দুর্ভোগ ডেকে আনছি? প্রশ্নটা থেকে যায়।

বর্তমানে পরিস্থিতির শিকার হয়ে আমরা শিশুদের হাতে প্রযুক্তি তুলে দিচ্ছি। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়, আমরা তাদের হাতে প্রযুক্তি দিয়েই ক্লান্ত, করছি না তাদের বিশেষ নজরদারি, রাখছি না কোনো খোঁজখবর যে শিশুরা হাতে থাকা প্রযুক্তিটি দিয়ে কী করছে? কীভাবে ব্যবহার করছে? কতক্ষণ ব্যবহার করছে এবং ব্যবহার করে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে কি না?

বিধিনিষেধের সময় প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় শিশুরা মুঠোফোনে নানান খেলায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। তারা বই থেকে মুঠোফোনকে গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। ফলে যেমন তারা পড়াশোনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তেমনি নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। অতএব, শিশুদের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির এমন বেড়াজাল সৃষ্টির জন্য দায়ী কিন্তু আমরা বড়রাই। কারণ, আমরাই তাদের কাঁচা বয়সে প্রযুক্তির হাতে সমর্পণ করছি। করছি না তাদের বিশেষ নজরদারি। সুতরাং আসুন আমরা শিশুদের প্রযুক্তির হাত থেকে রক্ষা করি, সুস্থ একটি জাতি গঠনে শিশুদের বেড়ে ওঠার পথ মসৃণ করে দিই। তবেই মিলবে শিশুদের মুক্তি।

*লেখক: জসীম উদ্দিন, শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।