প্রবীণবান্ধব সমাজ গড়ে তোলা প্রয়োজন
আজ ১ অক্টোবর বিশ্ব প্রবীণ দিবস। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিবছর ১ অক্টোবর বিশ্ব প্রবীণ দিবস পালন করে। প্রবীণদের সুরক্ষা এবং অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে এদিনটি বিশ্ব প্রবীণ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ৬০ বা ৬৫ বছর বয়সের একজন মানুষকে প্রবীণ বা সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে গণ্য করা হয়। সমাজে তাদের বিশেষ মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৬০ বছর বা এর ঊর্ধ্বে যারা রয়েছেন, তারা প্রবীণ বলে স্বীকৃত। পরবর্তী সময়ে তাদের সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
শিশু, কৈশোর ও যৌবন পেরিয়ে সবাইকেই প্রবীণ বয়সে পদার্পণ করতে হয়। প্রবীণ শব্দটা শোনামাত্রই চোখের সামনে এমন একজন মানুষের ছবি ভেসে ওঠে, যিনি বয়সের ভারে এবং বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় কাতর। অথচ এই প্রবীণেরাই একসময় ছিলেন টগবগে তরুণ। স্বযত্নে লালন-পালন করেছেন সন্তান, তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন জাতি, সমাজ। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মে কর্মক্ষমতা হারিয়ে আজ তারাই সবচেয়ে বেশি অবহেলার শিকার। প্রবীণদের সমস্যা আসলে বয়সের সমস্যা নয়, সমস্যাটি পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্কের সমস্যা, মনোগত অবস্থার সমস্যা।
একটা সংখ্যা এখনো আছে, যারা তাদের পরিবারের প্রত্যেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধার প্রতি সহানুভূতিশীল। এখনো তারা পিতা-মাতাকে মনেপ্রাণে দেখেন, সেবা করেন। কিন্তু এই সংখ্যাটা অতি নগণ্য। বর্তমান সমাজে আধুনিকতার নামে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার অধিক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ছেলেমেয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পিতা-মাতাকে বোঝা মনে করে। তারা তাদের সন্তান ও সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। এমনকি বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে ভরণপোষণ না দিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে বাধ্য করছে।
বেশির ভাগ পরিবারেই বৃদ্ধদের বিভিন্ন অযত্ন আর অবেহেলার শিকার হতে হয়। উপার্জনের ক্ষমতা না থাকায় তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং তাদের ওপর বিভিন্ন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে এই বৃদ্ধ বয়সে এসেও তারা বিনোদন, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
যে পিতা-মাতা নিজেদের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য সব বিসর্জন দিয়ে সন্তানদের জীবনের ধন ভেবে লালন-পালন করেছেন, তাঁরাই আজ সবচেয়ে বেশি বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। অথচ একবারও কি ভেবে দেখেছি আমরাও একদিন বুড়ো হব, কানে কম শুনব, আমাদেরও স্মৃতিভ্রম হবে, হাত-পা কাঁপবে। তখন হয়তো কর্মফল হিসেবে বৃদ্ধাশ্রমে স্থান হবে আমাদেরও।
বর্তমান শতাব্দীতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি, সচেতনতা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন মৃত্যুহার যেমন হ্রাস করেছে, তেমনি মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। ফলে বিশ্বসমাজে বয়স্কদের সংখ্যা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় দেড় কোটি প্রবীণ বা সিনিয়র সিটিজেন রয়েছেন। আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে প্রবীণদের সংখ্যা হবে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ। ২০৫০ সালে এ সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি এবং ২০৬১ সালে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি প্রবীণ জনগোষ্ঠী হবে। ২০৫০ সালে বাংলাদেশে প্রতি ৫ জনে ১ জন প্রবীণ হবেন, যা ওই সময়ের জনসংখ্যার ২০ শতাংশ। বাংলাদেশে আগামী ২০৫০ সালে শিশুর চেয়ে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা ১ শতাংশ বেশি হবে। ওই সময় শিশুর সংখ্যা হবে ১৯ শতাংশ এবং প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা হবে ২০ শতাংশ। ফলে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই ক্রমবর্ধমান প্রবীণ জনসংখ্যাকে আর্থসামাজিক নিরাপত্তা দেওয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়বে।
১৯৯৭-৯৮ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশে প্রবীণদের জন্য বয়স্ক ভাতা চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া কিছু সরকারি–বেসরকারি সংস্থা প্রবীণদের কল্যাণে কাজ করে আসছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য। ফলে বৃদ্ধ বয়সে এসেও প্রবীণেরা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি বেঁচে থাকার তাগিদে কয়েক লাখ প্রবীণ ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন ধারণ করছেন।
এক বেসরকারি জরিপে জানা গেছে, বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ প্রবীণ অসুস্থ, অসহায়, অবহেলিত, নিঃসঙ্গ ও সেবাহীন জীবন যাপন করছেন।
যাহোক, প্রবীণদের নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। প্রবীণদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। সন্তানের আবেগপূর্ণ মমতা আর পারিবারিক সেবাযত্নের মাধ্যমে প্রবীণদের শেষ সময়টুকু সুখময় করে তুলতে হবে। সন্তানের পাশাপাশি রাষ্ট্রকে প্রবীণদের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রবীণদের থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা, সরকারি বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
সর্বোপরি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রবীণবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। প্রবীণদের অবজ্ঞা না করে তাদের প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা আর নবীনদের উদ্যম নিয়ে সোনার বাংলা গড়ে তুলতে হবে।
*আসিফ আহমেদ, শিক্ষার্থী, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]