প্রকৃতির সান্নিধ্যে সুন্দরবনে...
সুন্দরবনের গহিনে ঢুকে পড়েছি। হঠাৎ দেখি হরিণ, বানর সব প্রাণভয়ে দৌড়াচ্ছে। রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে দেখি এক বাঘ। আমিও প্রাণপণে ছুটতে লাগলাম। হঠাৎ পায়ের সঙ্গে কিছু একটা বেঁধে পড়ে গেলাম। ঘুমও ভেঙে গেল। আতঙ্কভরে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে দেখি সকাল সাতটা বাজে। চোখে যেন সেই স্বপ্ন ভাসছিল। সঙ্গে আতঙ্ক। তবু কাছ থেকে সুন্দরবন দেখার তৃষ্ণা মেটেনি।
আজাহার মাহমুদ ভাই দুই দিন আগেই বলছিল সাতক্ষীরা থেকে সুন্দরবন ভ্রমণের কথা। সাতপাঁচ না ভেবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অচেনা পথে যাত্রা শুরু করলাম একাই। রাতের দিকে পৌঁছালাম শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জে। বাস থেকে নেমে আজাহার ভাই, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক নাইম ভাই আর বশেমুরবিপ্রবির সাংবাদিক মাহমুদ ভাইয়ের সঙ্গে। কুশল বিনিময় শেষে উদরপূর্তি করে উঠলাম বর্ষা রিসোর্টে। জানতে পারলাম সকালে আরও দুজন যোগ দেবে।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি ক্যামেরাম্যান মামুন হাজির। কিছুক্ষণ বাদে মোস্তাফিজ। মোট ছয়জন বেরিয়ে পড়লাম রিসোর্ট থেকে। সকাল ১০টায় রিসোর্টের পাশে চুনা নদীর কোলঘেঁষা কলবাড়ি মোড়ে নাশতা সেরে রওনা দিলাম নীলডুমুর খেয়াঘাটের দিকে। রাস্তার দুই ধারে থাকা অসংখ্য চিংড়ি আর কাঁকড়া ঘেরে চোখ আটকে গেল। ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানেরও ঘের রয়েছে সেখানে। ঘাটে পৌঁছে বন বিভাগ কর্তৃক ‘পাস’ ও দুজন গার্ড নিয়ে গেলাম খোলপেটুয়া ঘাটে। নোঙর করা নির্ধারিত ইঞ্জিনচালিত নৌকায় উঠতেই নৌকা চলতে লাগল আপন গতিতে।
ঘণ্টাখানেক চলার পর নৌকা ভিড়ল কলাগাছি ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রে। নামতেই অভ্যর্থনা জানাল একদল বানর। হাতে চিপস দেখে একটি বানরের তাড়া খেয়ে চিপস ফেলে দিলাম ভোঁ–দৌড়। সামনে একটু এগিয়ে যেতেই হরিণের দেখা। বানর ও বন্য হরিণকে চিপস ও মুড়ি খাওয়ানোর পর উদ্দেশ্য বনের গহিনে প্রবেশ। সঙ্গে থাকা গার্ড আমাদের পাগমার্ক (বাঘের পায়ের ছাপ) ও খাড়া শ্বাসমূল দেখিয়ে সতর্ক করলেন। তাঁরাই সুন্দরবনের সুন্দরী, গোলপাতা, গরান, গেওয়া, কেওড়া, কাঁকড়া, খলিশাসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ও ফার্ন চেনালেন। দেখা মিলল রংবেরঙের কাঁকড়ারও। সেখানকার ওয়াচ টাওয়ার থেকে সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করারও সুযোগ হয়েছিল। টাওয়ার থেকে নেমে কাঠের সেতু দিয়ে ঢুকলাম বনের গহিনে।
বনের গহিন থেকে ফিরে পরবর্তী গন্তব্য দোবেকি। মালঞ্চ নদীর বুক চিরে এগিয়ে চলছে নৌকা। মৃদু বাতাস আর মামুনের ক্যামেরার ক্লিকে ক্লিকে নৌকাতেই কাটল আরও দেড় ঘণ্টা। সময় তখন বিকেল। নৌকা থেকে নেমেই দেখি মোবাইলের নেটওয়ার্ক গায়েব। তবে অবাক হলাম চারদিকে লোনাপানির নদীর মধ্যে মিঠাপানির পুকুর দেখে। মিলল হরিণের দেখাও। পুকুরটির আরেক পাশে পড়ে রয়েছে জব্দ হওয়া কয়েক শ নৌকা। ফেরার আগে মালঞ্চ রেস্টহাউসের ফরেস্ট অফিসারের আতিথেয়তাও দিন শেষে এক কাপ চা প্রশান্তি এনে দিল। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। সারা দিনে বাঘের দেখা মেলেনি কোথাও। সেই আক্ষেপ নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম ফেরার পথে।
ফেরার সময় নীলডুমুর খেয়াঘাটে নেমে জানলাম দেওয়ান শাহাদত মামার খাবার হোটেল সেরা। এখানে বেশ কিছু সুস্বাদু মাছ পাওয়া যায়, যেগুলো দেশের অন্য কোথাও তেমন দেখা মেলে না। চিংড়ি, আবাদি, সিলেট মাছ, ভেটকি, ভাঙান, পাসসে, ট্যাংরা, কাইন, বাঁশপাতা, খয়রা, তপসে, দাঁতনে, ছোট মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির নদীর মাছ খাওয়ার সুযোগ তো থাকছেই। তবে হরিণের মাংস সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ফিরে আসার আগেই খাবার শেষ। তাঁরা আমাদের রান্না করে দিতে সম্মত হলেন। রান্নার ফাঁকে তাঁর স্বরচিত কবিতা মুগ্ধ করল আমাদের।
খাওয়া সেরে রাতে ফিরলাম রিসোর্টে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মাহমুদ ভাইসহ রিসোর্টের আশপাশে চক্কর দিলাম চারপাশে। এবার ফেরার পালা। পথে দেখা মিলল শ্যামনগরের ঐতিহাসিক জমিদারবাড়ি। সময়স্বল্পতায় সব জায়গায় যেতে না পারলেও ভ্রমণের স্মৃতি অমলিন হয়ে থাকবে আজীবন।
*লেখক: আজাহার ইসলাম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া