পাবিপ্রবির একজন বাবু কাকা

মঙ্গল শেখ বাবু মণ্ডল

দুপুর তখন বারোটা। মধ্য আকাশে সূর্যের প্রখরতা থাকার কথা। তবে সেই মুহূর্তে মেঘে ঢেকে আছে মাথার উপরের আকাশটা। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি তখন ঝরে পড়ছে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শীতের তীব্রতাকে আরেকটু বাড়িয়ে দিয়েছে। এই শীত এবং বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে কেউ বের হতে চাইবে না ঘর থেকে। কিন্তু শীত থাকুক আর বৃষ্টি থাকুক, গতিময় জীবন তো বয়েই চলে অবিরাম। গতিময় জীবনের একটি ধারায় বয়ে চলছে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও। শীত আর বৃষ্টিকে উপেক্ষাকে করে শিক্ষার্থীরা চলে এসেছে পরীক্ষা দিতে। শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে চলে এসেছেন কর্মস্থলে।
কয়েক দিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি একজন মানুষের সন্ধানে আছি। একটু মন খুলে কথা বলার ইচ্ছা আমার ওনার সঙ্গে। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। এই দেখছি এই দেখছি না, চোখের পলক ফেলতেই উনি হাওয়া। শীত আর বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আমিও বের হলাম, উদ্দেশ্য সেই মানুষটাকে খোঁজা। নিজের কিছু আনুষঙ্গিক কাজ সেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার পেরিয়ে প্রশাসনিক ভবনের দিকে আমার গন্তব্য। উদ্দেশ্য প্রশাসনিক ভবনের সামনে গিয়ে কাউকে জিজ্ঞাসা করলে হয়তো তারা মানুষটার সন্ধান দিতে পারবে।

আমাকে বেশি দূর যেতে হয়নি, কেন্দ্রীয় মাঠ পার হয়ে প্রশাসনিক ভবনের দিকে মোড় নিতেই প্রশাসনিক ভবনের সামনের ফুলের বাগানের দিকে চোখ পড়ল। আমার কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে পেয়ে গেলাম। তিনি আপন মনে কাস্তে হাতে বাগানে কাজ করে যাচ্ছেন। এই মানুষটাকে সবাই কাজের মধ্যেই খুঁজে পায়, যখনই দেখা মেলে, তখন তিনি কাজে ব্যস্ত।

ওনার পুরো নাম মঙ্গল শেখ বাবু মণ্ডল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার কাছে তিনি বাবু কাকা নামেই পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বাবু কাকা এক পরিচিত নাম, এক ভালোবাসার নাম। কাজের একাগ্রতা আর সরল একটা মন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার মন জয় করে নিয়েছেন।

বাবু কাকার ভাষায়, ‘এখানে কাজ করে সবার ভালোবাসা পেয়েছি। এটাই তো আমার বড় পাওয়া। ছাত্ররা আসে কথা বলে, আমার সঙ্গে ছবি তোলে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী আছে! দুনিয়ার আর কয়দিনের! একজনের সঙ্গে অন্যজনের ভালোবাসাই বড়। আমি সবার সেই ভালোবাসা অর্জন করতে পেরেছি। আক্ষেপের কিছুই নেই।’

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বাবু কাকা এ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারেরই একজন। নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্য হিসেবে পরিচয় দিতেই গর্ববোধ করেন। রাজাপুরের সেই ফসল ভরা মাঠ থেকে আজকের পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সবকিছু বাবু কাকার সামনে দিয়ে ঘটা। তাই তো তিনি বলছেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি প্রফেসর ড. আমিন উদ্দীন মৃধা স্যার থেকে আজকের ভিসি প্রফেসর এম রোস্তম আলী স্যার, সবাই আমার চোখের সামনে দিয়ে এসেছেন। সেই ফসলি জমি থেকে আজকের এতগুলো বহুতল ভবন সবকিছুই আমার স্মৃতিতে এখনো পরিষ্কার হয়ে আছে।’

এক মনে কাজ করতে থাকা বাবু কাকার সঙ্গে আমি গিয়ে আলাপ জমাতে শুরু করি। তবে আমার কথা যে ওনার কাজে খুব ব্যাঘাত ঘটিয়েছে, সেটা বোঝা যায়নি। হাতে কাস্তে দিয়ে বাগানের আগাছা তুলছেন অন্যদিকে আমার সঙ্গে কথা বলছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কাকা এই শীতের দিনে কাজ করতে নেমে গেছেন, কেউ কী আপনাকে দায়িত্ব দিল নাকি?’ কাকা জবাব দিলেন, ‘ব্যাটা, কেউ আমাকে দায়িত্ব দেওয়া লাগে নাকি! এই বিশ্ববিদ্যালয় আমার, এটাকে সুন্দর রাখাও যে আমার দায়িত্ব।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ঢুকেই যদি দেখে বিশ্ববিদ্যালয় অপরিষ্কার তাহলে লোকে ভাববে কী! এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনের বাগানটার যত্ন নিচ্ছি ভালো করে যেন কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেই বুঝতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়টা সুন্দর।’
এরপর ধীরে ধীরে আলাপ জমতে থাকে। বাবু কাকা বলতে থাকেন অনেক কথা। আজকের বঙ্গবন্ধু হল যেখানে, সেখানেই বাবু কাকার বাড়ী ছিল। সরকার জমি অধিগ্রহণ করার পর জমি কিনে বাবু কাকা আবার নতুন বাড়ী করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে। এক ছেলে আর স্ত্রীসহ মাত্র তিনজনের পরিবার বাবু কাকার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলের চাকরির জন্য প্রথমে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার স্বীকার হোন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিকিউরিটি বিভাগে চাকরি হয় ছেলের। ছেলের চাকরিটা হয়ে যাওয়াতে অনেকটা নির্ভার হোন বাবু কাকা।

বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার আগে কাজ করতেন পাবনা শহরের আবদুল হামিদ রোডে ফ্রিজ, এসির দোকানে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর সেই কাজ ছেড়ে চলে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। নির্ধারিত কোনো চাকরি ছিল না। যখন যেখানে প্রয়োজন হয়েছে সেখানেই খেটেছেন। কখনো পরিশ্রমের বিনিময়ে অর্থ পেয়েছেন, কখনো পাননি। কেউ টাকা দেবে বলে কাজ করিয়ে নিয়েছেন কিন্তু টাকা দেননি, আবার কেউ দিয়েছেন। তবে এসব নিয়ে আক্ষেপ নেই বাবু কাকার। বাবু কাকার ভাষায়, ‘এখানে কাজ করে সবার ভালোবাসা পেয়েছি। এটাই তো আমার বড় পাওয়া। ছাত্ররা আসে কথা বলে, আমার সঙ্গে ছবি তোলে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী আছে! দুনিয়ার আর কয়দিনের! একজনের সঙ্গে অন্যজনের ভালোবাসাই বড়। আমি সবার সেই ভালোবাসা অর্জন করতে পেরেছি। আক্ষেপের কিছুই নেই।’

হ্যাঁ, বাবু কাকা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার ভালোবাসা অর্জন করতে পেরেছেন। বাবু কাকা সবার কাছেই আপন একজন মানুষ, সদা হাস্যোজ্জ্বল, খোলা মনের অধিকারী একজন ব্যক্তি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে ছাত্রনেতারা সবাই বাবু কাকার আপন মানুষ। ছাত্রনেতাদের প্রসঙ্গ টেনে এনে বাবু কাকা বললেন, ‘সেই সবুজ (বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের প্রথম আহ্বায়ক) থেকে শুরু করে আজকের আসিফ (বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি), বাবু (বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক) সবাই আমার চোখের সামনে দিয়েই রাজনীতিতে এসেছে। কখনো খারাপ কিছু করেনি আমার সঙ্গে। সবুজ ক্যাফেটেরিয়ায় বলে দিয়েছে (বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেয়ার বর্তমান ঠিকাদার) বাবু কাকা এখানে এসে খাওয়াদাওয়া করলে যেন পয়সা না নেয়। অনেক সময় গিয়ে খেয়ে আসি। টাকা নেয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার খাওয়ার অভাব হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো অনুষ্ঠানে আমার দাওয়াত থাকেই।’

কথা বলতে বলতে বাবু কাকার সঙ্গে প্রশাসনিক ভবনের সামনের বাগানের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে চলে যাই। বাবু কাকার হাতে অনবরত খুপড়ি চলছেই। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় যখন ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে, তখন ফুলের বাগানের প্রসঙ্গ না তুলে পারলাম না। এ প্রসঙ্গ তুলতেই বাবু কাকা চলে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. হাসেবুর রহমানের কথা। তিনি বলতে থাকেন, ‘প্রক্টর স্যার আসার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে সুন্দর করার কাজে নেমে গেছেন। যেখানে যেখানে ফুলগাছ লাগানো প্রয়োজন সবখানে ফুলগাছ লাগানোর ব্যবস্থা করেছেন। সঙ্গে আমাকে রেখেছেন। এসব ফুলগাছ দেখার দায়িত্ব আমার হাতে তুলে দিয়েছেন। আমি এখন ফুলগাছগুলোর যত্ন নিই। প্রক্টর স্যার প্রতিদিনই এগুলোর খোঁজখবর নিচ্ছেন।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রক্টরের ওপর উনি অনেক খুশি। একটা সময় প্রশাসন থেকে কাজ করিয়ে নিতো, কখনো টাকা দিতো, কখনো টাকা দিতো না। কিন্তু বর্তমান প্রক্টর ওনার কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, ঠিকমতো টাকা পাচ্ছে কি না, সেটার খোঁজ নিচ্ছেন। একই সঙ্গে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ওপরও খুশি। বাবু কাকা বলেন, ‘এখন আর কেউ টাকা মেরে খাওয়ার সাহস পায় না। প্রক্টর স্যার কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ভিসি স্যার সবাইকে বলে দিয়েছে আমার টাকা যেন কেউ না আটকায়।’

অনেকেই হাঁটতে গিয়ে ফুলগাছ ভেঙে ফেলছেন, মাড়িয়ে দিচ্ছেন এগুলো দেখে আপনার কষ্ট লাগে না? এ কথা জিজ্ঞেস করতেই বাবু কাকা বলে উঠলেন, ‘কষ্ট তো লাগেই ব্যাটা। কিন্তু কী করব! যারা ফুলগাছ ভাঙছে, পা দিয়ে মাড়িয়ে দিচ্ছে, তারা এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছেলেমেয়ে। তাদের ওপর তো আর রাগ করে থাকা যায় না। তাই নিজে গিয়েই ওই গাছগুলোর যত্ন নিই, নতুন করে গাছ লাগিয়ে আসি।’
বাবু কাকা সব সময় পরিচ্ছন ক্যাম্পাস দেখতে চায়। বিভিন্ন সময় লেকের পাড়, মাঠের পাশে শিক্ষার্থীরা ময়লা ফেলে রাখে। এগুলো দেখে বাবু কাকার খারাপ লাগে। সেটা এভাবেই বললেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে সব সময় পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন। এখানে ময়লা–আবর্জনা জমে থাকলে খারাপ দেখায়। তাই নিজে যখনই দেখি কোথাও ময়লা পড়ে আছে, সেগুলো পরিষ্কার করে দিয়ে আসি।’

বাবু কাকার সঙ্গে কথা বলতে বলতে অনেক সময় হয়ে গেছে। খেয়ালই করিনি সময় যে এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে। বাবু কাকার সঙ্গে কথা অসমাপ্ত রেখে দিলাম। বলে আসলাম আরেক দিন সময় করে আবার আপনার কথা শুনব।

বিশ্ববিদ্যালয় ফুলে ফুলে ভরে উঠতে শুরু করেছে। কিছুদিনের মধ্যেই ভিন্ন এক রূপে সজ্জিত হবে পুরো পাবিপ্রবির ক্যাম্পাস। তখন কেউ বাগানে নিজের ছবি তুলবে, কেউ ফুলের ছবি তুলে নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের টাইমলাইন সাজাবে। কিন্তু এই ফুলের মালিকে কি কেউ স্মরণ করবে? কেউ হয়তো করবে, কেউ করবে না।
বাবু কাকারা অবশ্য কারও স্মরণে থাকার জন্য কাজ করেন না! বাবু কাকারা কাজ করেন নিঃস্বার্থে, অন্যের জন্য কাজ করেই যে বাবু কাকাদের আত্মায় প্রশান্তির ছায়া নেমে আসে, বুক ভরে ওঠে ভালোবাসায়। সব সময় কাজে ব্যস্ত পাবিপ্রবির এ নিবেদিত প্রাণ বাবু কাকা কোনো দিন ক্যাম্পাস থেকে চলে গেলে হয়তো বেশি দিন কেউ মনে রাখবে না। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি প্রতিটি গাছগাছালি, প্রতিটি বালুকণা ঠিকই বাবু কাকাকে মনে রাখবে। কারণ ওই সব গাছগাছালি আর বালুকণার সঙ্গে যে বাবু কাকার আত্মার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে।

লেখক: আবদুল্লাহ আল মামুন, শিক্ষার্থী, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়