পাবজি তরুণ প্রজন্মের প্রতিভা বিকাশে অন্তরায়
আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হলে ইন্টারনেট কিংবা স্মার্টফোনকে বাদ দেওয়ার কোনো উপায় নেই। কিন্তু বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে স্মার্টফোন কতটা সুফল এনে দিচ্ছে, সেটা ভাবার সময় এসেছে। মাস তিনেক আগে আমি গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। বিকেল বেলা বন্ধুদের সঙ্গে হাঁটতে বের হয়েছি। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার পাশে কিছু ১৮-অনূর্ধ্ব ছেলে আমার চোখে পড়ল। ওদের মধ্য থেকে শব্দ আসছিল, ‘মামা, মার মার। এবার ধর।’ আমি শব্দটা শুনে থেমে গেলাম। এবং আমার সঙ্গে থাকা বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম যে শব্দটা ওদের কাছ থেকে এল না? ও বলল, ‘হ্যাঁ, ওখান থেকেই এসেছে, ওরা পাবজি খেলছে।’
আমি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। গ্রামের এ পাবজি খেলার সংখ্যাটা বেশির ভাগই ১৬ কিংবা ১৮-অনূর্ধ্ব । এদের অনেকের পরিবারের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। কারও পরিবারে খাবারই ঠিকমতো জোটে না। অধিকাংশ ছেলে অনলাইন ক্লাসের দোহাই দিয়ে স্মার্টফোন কিনেছে। কিংবা কেউ কেউ পরিবারের চোখ ফাঁকি দিয়ে স্মার্টফোন কিনেছে। কিন্তু সবার আসল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে পাবজি খেলা। আজ থেকে ঠিক ১০ বছর আগের কথা যদি চিন্তা করি, তবে দেখা যাবে তখন স্মার্টফোন এতটা সহজলভ্য ছিল না, আর অনলাইনভিত্তিক গেমসও তেমন ছিল না। কিন্তু এখন স্মাার্টফোন খুব সহজলভ্য। এমন অবস্থা হয়েছে, সদ্য জন্মগ্রহণ করা বাচ্চার কান্নাও বন্ধ হচ্ছে মোবাইল দেখে।
বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে পাবজি মাদকের চেয়ে অনেকাংশে বড় নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদক সেবন করতে অনেকটা বেগ পেতে হয়, লোকজনের চোখ ফাঁকি দিয়ে সেবন করতে হয়। পাবজি খেলায় অতটা বেগ পেতে হয় না। মানুষের এটা নিয়ে মন্তব্য করারও সুযোগ থাকে না। পাবজি বর্তমানে সংক্রামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন খেললে তার আশপাশের সমবয়সের সবাইকে প্রভাবিত করছে। এটা শুধু যে গ্রামের ছেলেরা খেলছে তা নয়, শহরের অলিতে-গলিতে পাবজি খেলার আসর বসায় ছেলেরা। যেহেতু খেলাটা ইন্টারনেট ছাড়া খেলা যায় না, এখানে প্রতিদিন টাকা খরচ করে ডেটা কিনতে হয়, আবার টাকা দিয়ে ডলার কিনে তা দিয়ে খেলার সামগ্রী অনলাইনে কিনতে হয়। এর মাধ্যমে শুধু আর্থিক ক্ষতিই করছে না তরুণ প্রজন্ম, সঙ্গে নিজেদের মানসিক ও শারীরিক ক্ষতিও করছে।
দীর্ঘদিন পাবজি খেলার ফলে যেমন চোখের সমস্যা, মাথাব্যথা ও ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে। সবচেয়ে যে বিষয়টি ভাবার সেটা হচ্ছে, অপরাধপ্রবণতা। যখন ১৬ বছরের ছেলেটা পরিবারের কাছ থেকে টাকা না পায় মোবাইল ডেটা কিংবা ডলার কেনার জন্য, তখন ছেলেটা চুরি কিংবা ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হতে একটুও চিন্তা করে না। একে তো করোনার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। তাই এ সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন ১৮-অনূর্ধ্বরা। তারা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনছে। এখানে পরিবারের সদস্যদের বিশেষ করে মা-বাবার সচেতন হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। অন্যথায় পরবর্তী সময়ে একটা ব্যাপক হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। বিপর্যস্ত হতে পারে তরুণ প্রজন্ম। পরিবারের বাবা চাকরি করলে মাকে তাঁর সন্তানকে বেশি বেশি সময় দিতে হবে। কারণ আসক্তি, সে যে বিষয়ে হোক না কেন, খুব খারাপ। যেটা থেকে বের হয়ে আসা খুব কঠিন।
রাসেল ব্র্যান্ডের একটা উক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘নেশা হলো এক মারাত্মক ব্যাধি, যার ইতি টানতে হলে আপনাকে হাসপাতাল কিংবা জেলে যেতেও হতে পারে।’ তাই এ পাবজি নেশা থেকে, এ আসক্তি থেকে বাঁচাতে হলে পরিবারের সদস্যদের সচেতনতার বিকল্প নেই। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশে বসে ওয়েবসাইটে পর্নোগ্রাফি দেখার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এটা নিশ্চয়ই প্রশংসার যোগ্য। এটার মতো করে পাবজিসহ সব অনলাইন খেলা বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
যেহেতু এটা একটা গ্রুপ গেমস, একসঙ্গে অনেকজন মিলে খেলতে পারে। তাই এর দ্বারা ক্ষতিটাও খুব বেশি হচ্ছে। নিজেদের অতিরিক্ত আধুনিক ভেবে ভেবে সমাজের কেউ কেউ ছেলেমেয়ের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিচ্ছেন। কিন্তু আসলে তারা স্মার্টফোন দিয়ে কী করছে, তার খোঁজ নিচ্ছেন না। অনলাইন ক্লাস করতে গিয়ে সে কী করছে অনলাইনে, কোনো গেমস খেলছে কি না, এই বিষয়ে খুব সচেতন হওয়া উচিত। অন্যথায় এর ভয়ংকর পরিণাম ভোগ করতে হবে তাঁদেরই। টাকার অভাবে যখন তরুণদের পাবজি খেলা বন্ধ হয়ে যায়, তখন টাকা উপার্জনের জন্য তারা গ্রুপিং করে অপরাধ শুরু করে। জড়িয়ে যায় নানা ঘৃণিত অপরাধের সঙ্গে।
*লেখক: মৃদুল মিত্র, উপপরিদর্শক, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, পুলিশ