পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের মন্ত্রী আছে, জনগণের তো নেই
শনিবার সকাল সাতটায় বাসা থেকে বেরিয়েছি। দাঁড়িয়ে আছি কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে। রাস্তায় নেই কোনো কোলাহল। নেই হর্নের শব্দ। নেই বাসচালকের সহকারীদের হাঁকডাক। ভাবতে শুরু করলাম, আমি কি আসলেই জ্যামের শহর ঢাকায় আছি, নাকি ভিন্ন কোনো স্থানে! এ চিন্তা করতে করতে এবং বাসের অপেক্ষায় ৩০ মিনিটের বেশি সময় কেটে গেল বাসস্ট্যান্ডেই। মাথায় এল, না, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে তো চলবে না। ভিন্ন কোনো উপায় বের করতেই হবে।
দেখলাম, একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশা এগিয়ে আসছে। ‘এই সিএনজি, এই সিএনজি’ বলে ডাক দিলাম। থামল। ‘যাবেন, বারিধারা?’ চালক বললেন, ‘যাব। তবে ৫০০ টাকার এক টাকা কম দিতে পারবেন না।’ আমার মাথা চক্কর দেওয়া শুরু করল। বাসে কল্যাণপুর থেকে বারিধারার ভাড়া হলো ৩০ টাকা। প্রতিদিন যাতায়াতে খরচ হয় ৬০ থেকে ৮০ টাকা। ৮০ টাকা করে হিসাব করলেও ৫০০ টাকা দিয়ে কমপক্ষে ছয় দিন কল্যাণপুর-বারিধারা যাতায়াত করা যায়। অথচ আজ শুধু একবার যাওয়ার জন্যই গুনতে হচ্ছে ৫০০ টাকা! সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালককে বললাম, ‘যাব না।’ চালক হেসে বললেন, ‘আমি তো কমই চাইছি। আরও কয়েকটা দেখেন।’
আরও ২০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর দেখলাম, একজন সিএনজি চালক ডাকছেন, ‘বনানী, গুলশান-২।’ বললাম, ‘কত নেবেন?’ চালক বললেন, ‘রিজার্ভ যাইবেন না অন্য যাত্রী উঠামু।’ বললাম, ‘রিজার্ভ গেলে কত এবং অন্য যাত্রী উঠালে কত?’ চালক বললেন, ‘রিজার্ভ গেলে ৬০০ টাকা। অন্য যাত্রী উঠালে প্রতি যাত্রী ১৫০ টাকা।’ কী আর করার, সিএনজিতে উঠলাম। চালককে বললাম, ‘অন্য যাত্রী ডাকেন।’ চালক ডাকতে থাকলেন—কয়েক মিনিটেই পেছনে তিনজন এবং সামনে দুজন যাত্রী বসে পড়লেন।
সিএনজিতে যাত্রীরা একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করছেন। একজন বললেন, ‘ভাই দেখছেন, কী একটা অবস্থা। দেশের মানুষকে জিম্মি করে ফেলছে পরিবহন খাতের লোকজন।’ আরেকজন বললেন, ‘ডিজেলের দাম বাড়ায় ধর্মঘট করার মানুষ আছে। কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় কথা বলার মানুষ নেই।’ সামনের একজন যাত্রী বললেন, ‘ভাই, পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের মন্ত্রী আছে, জনগণের তো আর মন্ত্রী নাই। তাই তাদের পক্ষে কথা বলার মানুষ আছে, তাদের ধর্মঘট করার সাহস আছে। জনগণের জন্য কথা বলার কেউ নেই, জনগণের ধর্মঘট করারও সুযোগ নেই।’ সবার মনেই ক্ষোভ। সবার মনেই দুশ্চিন্তা। সব জিনিসের দাম বাড়ছে। গাড়ি ভাড়াও বেড়ে যাবে।
তাহলে জীবন চলবে কীভাবে?
আমার পরিচিত লোকজন আমাকে বলেন, আমি নাকি একটু বেশি হিসাব করে চলি। বাস্তবতা হলো, সবাই হিসাব করে চলে। কিন্তু কারোটা বোঝা যায়, কারোটা যায় না।
যা-ই হোক, চলে এলাম গুলশান-২। সেখান থেকে রিকশায় ১০০ টাকা দিয়ে বারিধারা। ২৫০ টাকা খরচ কেবল অফিস যেতেই। বাসায় ফিরতেও তো আবার এ রকমই খরচ হবে। এসব চিন্তাই শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। কাজে কোনো মনোযোগ বসছে না। অন্যান্য দিন লাঞ্চ আওয়ারের আগেই আমার ৯০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। দুপুরের খাবারের পর তেমন কাজের চাপই মাথায় থাকে না। আজ লাঞ্চ আওয়ার ঘনিয়ে আসছে, কাজ হয়নি কিছুই। মাথায় শুধু একটাই চিন্তা, এভাবে চললে কীভাবে কী হবে! ফোন দিলাম কয়েকজন বন্ধুকে। তাদের কণ্ঠেও হাতাশার বাক্য। বুঝলাম, বর্তমানে দেশের কোটি কোটি মানুষ দুশ্চিন্তায় ভুগছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দুর্বার নেতৃত্বে দেশ যখন এগিয়ে চলছে। দেশের নানান উন্নয়ন যখন বিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছে। এমন সময় জনগণের মনমেজাজ ফুরফুরে থাকা দরকার ছিল। দুঃখজনক হলো, পরিবহন ধর্মঘট, সম্ভাব্য ভাড়া বৃদ্ধি, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি ইত্যাদি বিষয় জনগণকে মানসিক রোগী বানিয়ে ফেলছে। আশা করি জনগণের সরকার জনগণের কষ্ট বুঝবে। দুঃখগুলো বিবেচনা করবে। দ্রুত সৃষ্ট সমস্যার যৌক্তিক সমাধান করবে। জনগণকে তাদের পাশেই রাখবে। দেশের দায়িত্বশীল সবার কাছে আহ্বান, জনগণকে একটু শান্তি দিন, পরিবহন ধর্মঘট উঠিয়ে নিন।