নারীমুক্তির জন্য দরকার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন

ছবি: সংগৃহীত

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বব্যাপী নারীর প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক মূল্যায়নের দাবিতে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় নারী সম্মেলনে প্রতিবছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব করা হয়। ১৯১১ সাল থেকে নারীদের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

নারী দিবসের অন্যতম উদ্দেশ্য সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক—সব ক্ষেত্রে বৈষম্যহীনভাবে নারীর মর্যাদা অনুভব করা। এই বছর নারী দিবসের প্রতিপ্রাদ্য, নেতৃত্বে নারী: কোভিড-১৯ পৃথিবীতে সমান ভবিষ্যৎ লাভ। কিন্তু আসলেই সমান ভবিষ্যৎ নির্মাণ সম্ভব হবে! আমাদের দেশে নারী প্রধানমন্ত্রীসহ রাজনীতিতে কিছুটা নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেছে। বাংলাদেশ প্রশাসনের অ্যাডমিন ক্যাডারে ২৬ শতাংশ কর্মকর্তা নারী। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নের পথে বাংলাদেশ এখনো বহু পিছিয়ে।

উপজেলা পর্যায়ে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদ ও মহিলা ইউপি সদস্য পদে নির্বাচিতদের আদতে কোনো ক্ষমতা থাকে না। কিন্তু সরাসরি উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউপি চেয়ারম্যান পদে নারীর অংশগ্রহণ খুবই সীমিত। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ১ হাজার ২৫১টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে মাত্র ৭২টি চেয়ারম্যান পদে নারী প্রার্থী ছিল, আর জিতেছিলেন মাত্র ১২ জন। ১৯৯৭ সালের ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নারী প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ১০২ জন। জিতেছিলেন ২৩ জন। ২০০৩ সালে ২৩২ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতেছিলেন ২২ জন। সর্বশেষ ২০১১ সালের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন ২২৬ জন। বর্তমান সংসদে সরাসরি ভোটের মাত্র ২২ জন নারী সাংসদ রয়েছেন । সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে সর্বমোট ৬৯ জন নারী সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। অথচ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০বি ধারায় বলা হয়েছে, ২০২০ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব স্তরে ৩৩ শতাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

নারীর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতায়নের পাশাপাশি প্রান্তিক পর্যায়ে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন দরকার। অর্থনীতিতে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ কম বলেই তুচ্ছ ঘটনায় নারীকে তালাক অথবা স্বামী কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব হলেই নারীর ব্যক্তিত্বকে অবজ্ঞা করতে পারবে না সমাজ।
উদারনৈতিক নারীবাদীরা মনে করেন, গৃহকর্ম ও মাতৃত্বের মতো গতানুগতিক ভূমিকার পাশাপাশি পুরোপুরি কর্মজগতে প্রবেশ নারীমুক্তির উপায়। নারীবাদী তাত্ত্বিক জন স্টুয়ার্ট মিল ও হেরিয়ার টেইলর বলেন, নারী-পুরুষের সম-অধিকারের জন্য নারীদের ঘরের বাইরে কাজ করতে হবে। শুধু নারী বাইরে কাজ করলেই বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে, বিষয়টা এমন নয়। বরং নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনটা প্রথমে জরুরি।

আমরা পুরুষের বাইরের কাজকে উৎপাদনশীল এবং নারীর গৃহস্থালির কাজকে সাধারণ হিসেবে দেখি বলেই এই বৈষম্য প্রবল হচ্ছে। সরাসরি আর্থিক লেনদেন না থাকায় আমরা গৃহস্থালির কাজকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখি না। পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৫-এর মতে, দেশে ১ কোটির অধিক নারী দৈনিক ১৬ ঘণ্টা করে গৃহস্থালির কাজ করে, যার আর্থিক মূল্য হিসাব করলে কয়েক হাজার কোটি ডলারে দাঁড়াবে।

আবার গৃহস্থালির কাজকে ধরে রেখেছি ‘নারীর কাজ’। ফলে কর্মজীবী নারীদের গৃহস্থালির কাজও করতে হয়। গৃহস্থালির কাজ যে শুধু নারীর, এই ধারণাও পাল্টাতে হবে। কেননা, কর্মজগতে কাজ করা নারীদের এই ধারণার কারণে আমরা বাইরের কাজের পাশাপাশি গৃহস্থালির কাজ চাপিয়ে দিচ্ছি। সন্তান লালন-পালন ও গৃহস্থালির যাবতীয় কাজ নারী-পুরুষ উভয়ের। এই কাজকে নারীর কাজ ধরে নিয়ে পুরুষের সহযোগিতার আলাপও নারীর ওপর বৈষম্য। বরং পরিবারের কাজ নারী-পুরুষ উভয়ের। উভয়ের অংশগ্রহণে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর হবে।

নারী প্রাকৃতিকভাবে পুরুষের চেয়ে ভিন্ন, এটা বাস্তব। কিন্তু নারী প্রাকৃতিকভাবে দুর্বল নয়, বরং সমাজ ও সংস্কৃতি তাকে দুর্বল করেছে, যার অন্যতম মাধ্যম মিডিয়া। বিজ্ঞাপন চিত্র ও মডেল হিসেবে নারীকে একটু অন্যভাবে উপস্থাপন করা হয়। টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে ছেলেকে সায়েন্টিফিক গল্প ও মেয়েকে ন্যাচারাল গল্প শোনানো হয়।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম নারীর সম-অধিকারের প্রশ্নে ঘোষণা করেছেন, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। এই যুক্তির পক্ষে নারীর জাগরণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রগামী হওয়ার আহ্বানে স্লোগান তুলেছেন ‘জাগো নারী জাগো নারী বহ্নিশিখা’।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ: ২৮ (১) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না। অনুচ্ছেদ: ২৮(২) মতে রাষ্ট্র ও গণজীবনের সব স্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করবেন । সংবিধানের ধারাসমূহ থেকে এটা পরিষ্কার, বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও গণজীবনের কোনো স্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার এবং নারীর পূর্ণ মানব মর্যাদাসংক্রান্ত বিষয়ে কোনো বিতর্ক থাকতে পারে না। সংবিধান সংরক্ষণ এবং সমুন্নত রাখার শপথ গ্রহণ করে যারা রাষ্ট্র ও সরকারি ক্ষমতায় বসেন, নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। যুদ্ধে পুরুষের মতো রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন নারীরা। তারামন বিবির মতো বহু নারী মুক্তিযোদ্ধা আছেন। অথচ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন গুটিকয়েক নারী। দুর্ভাগ্যক্রমে যুদ্ধের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে নারীর ধর্ষণের ঘটনা প্রচার লাভ করেছে অনেক বেশি, যেটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ।

যৌতুক প্রথা এই দেশের নারী মুক্তির পথে আরেকটি বাধা। যৌতুক প্রথা ও নারীর সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে কন্যাসন্তান জন্মদানকে এই দেশে সুখবর হিসেবে দেখা হয় না। ইভ টিজিংয়ের সামাজিক ব্যাধি নারীর সামাজিক অবস্থান তৈরিকে বাধাগ্রস্ত করছে। তবে যুগে যুগে নারীর চলার পথে এমন অনেক বাধা ছিল। সতীদাহ প্রথার কথাই ভাবতে পারি। ধর্মের দোহাই দিয়ে স্ত্রীকে স্বামীর সঙ্গে আগুনে নিঃশেষ হতে হতো। কিন্তু সমাজসংস্কারকেরা সে কঠিন পর্যায় থেকে নারীকে মুক্তির পথে নিয়ে এসেছেন। বর্তমানে নারীর সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। সংস্কারক হিসেবে কাজ করতে হবে তরুণ প্রজন্মকে। তরুণদের গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নারীর জন্য একটি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ করবে।

*লেখক: শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন, শিক্ষার্থী, সাউথ এশিয়ান (সার্ক) বিশ্ববিদ্যালয়, নয়াদিল্লি।