নবীনের আগমন, অনুভূতি ও আনন্দের অন্তহীন মেলবন্ধন
‘এসো হে নবীন
ভেদাভেদ ভুলে নবীন বা প্রবীণ
সোনামাখা সোনালি বরণ ডালায়,
সাজিয়েছি আজ হে নবীন, তোমাদেরই শুভেচ্ছায়’
স্বাধীন চিন্তাচেতনা ও মুক্ত বুদ্ধির কেন্দ্রস্থল হলো বিশ্ববিদ্যালয়। স্বাধীন সমাজের সর্বস্তরে মুক্ত বুদ্ধির চিন্তা ছড়িয়ে দেওয়ায় হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। স্কুল-কলেজের শিক্ষাজীবন অতিক্রম করে, ভর্তিযুদ্ধে জয়লাভ করে, দুই চোখে অসীম স্বপ্ন নিয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণ করে। চোখে থাকে হাজারো স্বপ্ন। সেই নবীনদের ‘নবীনবরণ’ যখন ভিন্নধর্মী হয়, তখন ভালো লাগার মাত্রা ও অনুভূতি বহুগুণে বেড়ে যায়।
শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ৪২তম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যার যাত্রা শুরু হয় ২০১৮ সালে মাত্র ৯০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে। এখন পরপর তিনটি ব্যাচের আগমনে মুখরিত শেহাবির অস্থায়ী ক্যাম্পাস (কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র, নেত্রকোনা)।
আমি বাংলায় ভালোবাসি, আমি বাংলাকে ভালোবাসি। সেই বাংলার, বাংলা বিভাগের ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের নবীনবরণ অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ২৭ মার্চ। বাঙালিয়ানায়, বাঙালি সাজে শুরু হয় এই নবীনবরণ। পোশাক হিসেবে ছিল প্রবীণ ও নবীন সব মেয়েদের বাঙালিয়ানা শাড়ি এবং ছেলেদের দাদু-গেঞ্জি ও লুঙ্গি। প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মিলেমিশে কাজ করা, মঞ্চ সাজানো, ছেলেদের বাঁশের কঞ্চি, কলাগাছ, ছন দিয়ে প্রবেশপথ তৈরি করা, বেলুন ফোলানো, মেয়েদের কক্ষ সাজানো, ককশিটে রং করা, আল্পনা আঁকা অর্থাৎ সবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা যেন এক মুহূর্তেই অগ্রজ–অনুজের সম্পর্কটাকে আরও মজবুত করে তুলেছিল। সম্পূর্ণ বাঙালি সাজে শেহাবির অস্থায়ী ক্যাম্পাস থেকে প্রায় ৫০০ একরের ক্যাম্পাস পর্যন্ত আনন্দ মিছিল যেন উৎসবে নতুন এক মাত্রা যোগ করেছিল।
নবীন শিক্ষার্থীদের গলায় ঝুলানো কিছু ভিন্নধর্মী লেখা, যেমন ‘মাইরের মধ্যে ভাইটামিন আছে’, ‘আমারে নিবা মাঝি লগে, এখানে জায়গা আছে’সহ আরও অনেক সুন্দর সুন্দর উদ্ধৃতি। তিন ব্যাচের শিক্ষার্থীদের বিভাগের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের সঙ্গে ছবি তোলা, আনন্দ মিছিল—এ যেন এক অন্য রকম আমেজ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন উপাচার্য রফিকউল্লাহ খান। আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলা বিভাগের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মো. আবদুল হালিম এবং মো. আঙ্গুর হোসেন। অনিবার্য কারণবশত বাংলা বিভাগের শিক্ষক সানজিদা ইসলাম আমাদের মাঝে উপস্থিত হতে পারেননি। কিন্তু তাঁর শুভেচ্ছাবার্তা ও শুভকামনা সব সময় আমাদের মনে রেখাপাত করেছে। আমরা সবাই তাঁর অনুপস্থিতি ভীষণভাবে অনুভব করেছি। অনুষ্ঠানে অন্য বিভাগের শিক্ষকেরাও উপস্থিত ছিলেন। ফলে আমাদের ভালো লাগার অনুভূতি বহুগুণে বেড়ে গিয়েছিল।
উপাচার্যের পায়রা ওড়ানোর মধ্য দিয়ে নবীনবরণ অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়। সহ–উপাচার্যকে সাদরে অভ্যর্থনা জানানোর পর নবীনদের আবির, মুড়ি–মুড়কি আর ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। মনে হয়েছিল, এ যেন এক উৎসবের আমেজ, যা পুরো পরিবেশ বা আবহকে রাঙিয়ে দিয়েছে। সবার বাঙালিয়ানা পোশাকে ভিন্নতর গ্রামীণ সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছিল। সহ-উপাচার্য নিজ হাতে নবীনদের দই দিয়ে মিষ্টি মুখ করান। এরপর স্যার এবং শ্রদ্ধেয় দুই শিক্ষককে উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁদের মূল্যবান বক্তব্য আমাদের আগামীর পথচলার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
নবীনেরা নিজেদের পরিচয় দেওয়ার মাধ্যমে একজন আরেকজনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। নবীনদের জন্য উপহার হিসেবে ছিল বাংলা অভিধান, রজনীগন্ধা এবং আরও অনেক আকর্ষণ। নাচ, গান, আবৃত্তি, অভিনয়, সংবাদ পাঠ, ফ্যাশন শো, র্যাফেল ড্র—কী ছিল না এ বরণ উৎসবে! এ যেন অন্য রকম আমেজ। সবচেয়ে বড় চমক ছিল সন্ধ্যার পর মাইকেল মধুসূদন দত্তের অমর সৃষ্টি প্রহসন ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’; যা আমরা মঞ্চস্থ করেছিলাম। হাতে সময় ছিল দুই দিন।
এই দুই দিনে বাংলা বিভাগের শ্রদ্ধেয় দুজন শিক্ষক এবং প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থীদের নির্ঘুম ও অক্লান্ত পরিশ্রমে আমাদের অনুষ্ঠানকে সার্থক করতে পেরেছিলাম। যাদের জন্য আমাদের এই কষ্ট, সেই নবীনদের একজনের বলা সেই উক্তি ‘আপু, আপনারা না থাকলে কিছুই পেতাম না, অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাদের। এত ভালোভাবে বরণ করে নেওয়ার জন্য।’ তার এই উক্তি এবং সবার প্রশংসা ও উৎসাহ আমাদের দুই দিনের ক্লান্তিকে যেন এক নিমেষেই দূর করে দিয়েছিল। মনে হয়েছিল, ‘হ্যাঁ,আমরা পেরেছি, আমরা পারি, আমরা পারব এবং আমরা সার্থক।’
লেখক: ইল্লিন জাহান ঊর্মি, ১ম ব্যাচ, বাংলা বিভাগ, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোনা