নদীমাতৃক দেশের নদী রক্ষার চ্যালেঞ্জ
সভ্যতার বিকাশ ও উন্নয়নে বাঙালি চিরকালই নদীর কাছে ঋণী থাকবে। ছোট-বড় অসংখ্য নদ-নদী বাংলাদেশের বুকচিরে বেয়ে চলছে অবিরত। নদীকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা বাঙালি সভ্যতায় নদীর গুরুত্ব, তাৎপর্য ও নদীকেন্দ্রিক জীবনাবস্থা বিবেচনায় বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃকার দেশ। ঐতিহাসিক এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নদীর সঙ্গে বাঙালির অস্তিত্বের মেলবন্ধনকে তাই অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। নদীকে ঘিরে একসময় দেশের অর্থনৈতিক ধারাগুলো আবর্তিত হতো। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আমরা আমাদের বিভিন্ন নদীবিনাশী, স্বার্থলোভী, প্রকৃতিবিমুখী কর্মকাণ্ড দ্বারা নদীগুলোকে গলাটিপে হত্যা করছি। অন্যদিকে আন্তদেশীয় নদীগুলোর পানিবণ্টন নিয়ে বিতর্ক আমাদের বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন করছে, হুমকিতে পড়ছে অসংখ্য ছোট-বড় নদীর অস্তিত্ব।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেও দেশে নদীর প্রকৃত সংখ্যা আজও নিরূপণ করতে না পারা নদীমাতৃক দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের জন্য বড় লজ্জার বিষয়। দেশে নদীর প্রকৃত সংখ্যা কত, তা নিয়ে যেন বিতর্কেরও শেষ নেই। নদী–সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, দপ্তর, এমনকি নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাছেও নেই নদীর সঠিক সংখ্যার হিসেব। শিশু একাডেমি প্রকাশিত শিশু বিশ্বকোষে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা বলা হয়েছে ৭০০-এর অধিক। আবার ২০০৫ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ শীর্ষক গ্রন্থে নদ-নদীর সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছিল ৩১০। ২০১১ সালে একই সংগঠনের করা অনুসন্ধানের আলোকে নদ-নদীর সংখ্যা বাড়িয়ে জানানো হয় ৪০৫টি। বিভিন্ন সূত্রে নদ-নদীর এই সংখ্যাগত তারতম্য দেখলে চোখ কপালে ওঠার মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়। এসব তথ্যের মাধ্যমে জানা যায় বাংলাদেশের নদ-নদীর সংখ্যা ২৫০ থেকে ১০০০ পর্যন্ত হতে পারে।
বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে নদী কতটুকু জড়িয়ে আছে, নদী সভ্যতার বিকাশে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে কতটুকু অবদান রাখে, তা দেশের আর্থিক পরিসংখ্যান ও ইতিহাসের আলোকে খুব সহজেই বলা যায়। নদীর বিশাল পানির উৎস এবং নদীবিধৌত পলিমাটির উর্বর কৃষিভূমি এ দেশের কৃষি উৎপাদনের মূল শক্তি। কিন্তু নদী নিয়ে পার্শ্ববর্তী বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতের পানিরাজনীতি বাংলাদেশের নদী রক্ষার বিষয়ে অশনিসংকেত দেয় বৈকি!
বাংলাদেশের বুকচিরে বয়ে চলা বেশির ভাগ নদী ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ–ভারতের এই অভিন্ন নদ-নদীর সংখ্যা ৫৪। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের উজানে ভারতের অবস্থান হওয়ায় ভারত এসব অভিন্ন নদ-নদীর পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে এবং আন্তর্জাতিক নদীর পানিবণ্টন–বিষয়ক কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের প্রয়োজন মতো নদীগুলোকে ব্যবহার করছে। এ কারণে দেশের অধিকাংশ নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানিস্বল্পতা দেখা দেয়। যার প্রভাবে প্রতিবছর দেশের কৃষিকে অবর্ণনীয় ক্ষতিরমুখে পড়তে হচ্ছে।
বাংলাদেশের আপত্তির মুখেও ভারত ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্প পরীক্ষামূলক চালু করে। পরবর্তী সময়ে আন্তদেশীয় নদীগুলোর পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা–বিতর্ক কেবল বেড়েছেই। গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমেও তিস্তাপ্রবাহের একটা বড় অংশ ভারত অপসারণ করে নিচ্ছে। একইভাবে বরাক নদের ওপর টিপাইমুখী বাঁধ প্রকল্প বাংলাদেশের নদীগুলোর পানিসংকটের ভাবনাকে উসকে দিচ্ছে। ভারতের প্রস্তাবিত ‘নদী সংযোগ প্রকল্প’ নদী ভাগাভাগির সমস্যা আরও কঠিন সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একইভাবে প্রকল্পটি বাংলাদেশের অধিকাংশ নদ-নদীর অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
২০১৭ সালে বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের এক প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি খবর প্রকাশ করে ভারতের সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার। যেখানে বলা হয়েছিল, গত ৪৫ বছরে বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক নদী শুকিয়ে মরে গেছে, যা ছিল ১ হাজার ৩০০-র মতো। শুকিয়ে এখন নদীর সংখ্যা নেমে এসেছে ৭০০–তে।
নদীগুলোর এরূপ অবস্থার জন্য আমরা কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারি না। নদীখেকোদের নদী দখল, নদীর ওপর অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ, অতিমাত্রায় পলিথিনদ্রব্য ব্যবহারের মাধ্যমে নদীর পানিপ্রবাহে বিঘ্ন, নাব্যতা সংকটসহ বহুমুখী সমস্যা সৃষ্টির জন্য আমাদের অদূরদর্শী চিন্তাভাবনাই মূলত দায়ী। নদীর তীরে গড়ে ওঠা দেশের বেশির ভাগ অপরিকল্পিত নগরায়ণ, কলকারখানা এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ওপর সঠিক তদারকির অভাবে নদীতে অবাধে মিশছে রাসায়নিক ক্ষতিকর দ্রব্যাদি। যার কারণে নদীদূষণ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আর এই দূষণের প্রভাবে নদীর জলরাশির বিশাল জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।
গবেষণায় উঠে এসেছে, গত ৫০ বছরে আমাদের দেশে প্রায় ২২ হাজার কিলোমিটার নদীপথ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অথচ নদীপথ বাংলাদেশের পরিবহনব্যবস্থার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। নদীর নাব্যতা–সংকট নৌপথকে বাধাগ্রস্ত করছে ঠিকই তবে নদীগুলো পুনরুদ্ধার এবং পুনঃখনন করে নদীপথকে যদি কাজে লাগানো যায়, তাহলে বাংলাদেশকে যানজট নিয়ে যে গুরুতর সমস্যায় পড়তে হচ্ছে, তা সহজেই বিলোপ করা সম্ভব। একইভাবে গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নেও নৌপথের গুরুত্ব অপরিসীম।
জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দেশের নদীগুলোর সারা বছর পানিপ্রবাহ ঠিক রাখা গেলে নৌপথে গ্রামীণ যোগাযোগব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধিত করা সম্ভব। একই সঙ্গে নদীর পানিতে সেচপদ্ধতি চালু রেখে যেমন কৃষিতে অধিক মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হবে, তেমনি ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আরও নিম্নগামী হওয়াকে রোধ করা যাবে।
শুধু বাণিজ্যিক বা পরিবহন নয়, নদীর প্রাকৃতিক সম্পদও দেশের আয়ের অন্যতম উৎস। বাংলাদেশের ইলিশ, চিংড়িসহ নানান প্রজাতির মাছ ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। জলজ জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় এবং বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রতিরোধে নদীরক্ষার বিকল্প কিছু নেই।
দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য, জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে, বন্যা, খরা, ভূবৈচিত্র্য ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় নদীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। নদীর ওপর নির্ভর করেই জীবিকা নির্বাহ করে দেশের একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী। নদীদূষণ মারাত্মক একটি পরিবেশদূষণ, যা মানুষের স্বাস্থ্যের অবনতি এবং বিভিন্ন রোগব্যাধির কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই নদীকে বাঁচাতে আমাদের প্রত্যেককেই ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতন হতে হবে এবং সামাজিকভাবে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যেতে হবে।
দেশে নদী রক্ষার সঙ্গে জড়িত আছে ২৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। নদীর অবৈধ দখল ও পরিবেশদূষণ রোধে আছে প্রয়োজনীয় আইন ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। তবু রক্ষা পাচ্ছে না নদী। নদী রক্ষায় ২০১৭ সালে ‘বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন’ ১৭টি সুপারিশ পেশ করে। সংগঠনটির স্বল্পমেয়াদি সুপারিশের মধ্যে রয়েছে-নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-কৃত্রিম লেক, সমুদ্রসৈকতে ইঞ্জিনচালিত নৌকার পোড়া মবিল, তৈল, গৃহবর্জ্য, শহর, হাটবাজার ও রাস্তাঘাটের ময়লা-আবর্জনা, প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন ইত্যাদি ফেলা বন্ধকল্পে আইনগত পদক্ষেপ এবং জনসচেতনতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। নদী আইন মানা রক্ষায় স্থায়ী সার্ভে কমিটি গঠন করা তিন মাস অন্তর নদীর পাড় সরেজমিনে পরিদর্শনপূর্বক নৌ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর ও পরিবেশবাদী সংগঠনের কাছে রিপোর্ট জমা দেওয়া, অবৈধ দখল থেকে নদী রক্ষায় দখলদারদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করাসহ পাঁচটি সুপারিশ। এ ছাড়া মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা সুপারিশগুলোয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের ১৭টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করা গেলে মৃত বা বিলুপ্ত হওয়ার হুমকিতে থাকা নদীগুলো প্রাণ ফিরে পাবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু নদীতে অবাধ পানিপ্রবাহ না থাকলে ওই সুপারিশ বাস্তবায়ন অর্থহীন হয়ে পড়বে। তাই ঘুরিয়ে–পেঁচিয়ে ভারত–বাংলাদেশের অভিন্ন নদীগুলোর ন্যায্য পানিবণ্টনের বিষয়টাই বাংলাদেশের সামনে চলে আসে। কেননা, বাংলাদেশে প্রবাহিত প্রায় সব নদীর মূল উৎপত্তিস্থল ভারত কিংবা ভারতের উজানে। তাই ভারতের নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দেশের জন্য তা বড় বিপদের কারণ হয়ে উঠবে। পানিচুক্তি নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির যে গড়িমসি, তা আমাদের কূটনীতিক প্রচেষ্টায় সমাধান করতে হবে। চীন ব্রহ্মপুত্র নদে বাঁধ দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তার প্রভাব ভাটির দেশ বাংলাদেশেও পড়বে বলে ধারণা নদী বিশেষজ্ঞদের। এ ক্ষেত্রে ভারতকে পানিবণ্টনের ন্যায্য হিস্যা বুঝিয়ে পেতে বাংলাদেশকেও সমর্থন জানাতে হবে।
অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, পরিবহন, জলবায়ু, পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা, ভূবৈচিত্র্য, জীববৈচিত্র্য বজায় রাখতে এবং দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে নদী রক্ষা এবং নদীর পরিচর্যা অতি গুরুত্বপূর্ণ। নদীকে বলা হয় বাঙালির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। তাই নদীর বিলীন হয়ে যাওয়া এবং নদীর অস্তিত্ব সংকটে পড়া আমাদের জন্য মোটেও মঙ্গলজনক হবে না। নদী রক্ষাই হোক স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের অন্যতম অঙ্গীকার—এই প্রত্যাশা থাকবে।
*লেখক: আকিজ মাহমুদ, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
**নাগরিক সংবাদে [email protected]-এ লেখা পাঠাতে পারেন