দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ও আমাদের দৌড়

প্রতীকী ছবি

সম্প্রতি আমার জেলার স্থানীয় এক ফেসবুক গ্রুপে একজন পোস্ট দিয়েছেন, ‘বিরিয়ানির দাম নাকি বেড়ে গেছে’। পোস্টের কমেন্ট বক্সে অনেককে হাহুতাশ করতে দেখলাম। খবরটা দেখার পর আমারও একটু খারাপ লাগা কাজ করল। যদিও বিরিয়ানির স্বাদ নিয়ে প্রশ্ন আছে। ঢাকার মতো জায়গায় যাঁরা বিরিয়ানি খেয়েছেন, তাঁরা কখনোই রংপুরের বিরিয়ানি পছন্দ করবেন না। সে যা-ই হোক, আমার বাড়ি গ্রামে হওয়ায় অনেক সময় বিভিন্ন কাজে শহরে আসতে হয়। শহরে এলেই যে বিরিয়ানি খাই, তেমনও না। তবে মাঝেমধ্যে কোনো উপলক্ষ এলেই রংপুরের বিরিয়ানির স্বাদ নেওয়ার সুযোগ হয়। এ কারণে বিরিয়ানির দাম বেড়ে যাওয়ার পোস্ট দেখে কিছুটা মনঃকষ্টে ভুগছি। এই বিরিয়ানির দোকানগুলো যাঁরা চালান, তাঁদেরই-বা কী করার আছে! তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে হু হু করে বাড়ছে, তাতে দাম বাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় আছে বলে মনে হয় না।

যে সময়ে ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করতেই অনেকের নাভিশ্বাস উঠছে, সেই সময়ে এসে বিরিয়ানির মতো বিলাসী খাবার নিয়ে এত চিন্তা করাটা দৃষ্টিকটু দেখায় যদিও।

২.
২০২০ সালে যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, আমাদের ক্লাস শুরু হয়েছিল জানুয়ারির শেষের দিকে। আমার পাশের গ্রামের এক ভাই ছিলেন, ফরিদুল ভাই। সেই সুবাদে তাঁর সঙ্গে একই মেসে আমি থাকতে শুরু করি। আমাদের মেসে রান্না হতো না, যার কারণে সবাই সবার মতো বাইরে খেয়ে নিত। ফরিদুল ভাইকে বাইরে থেকে খাবার দিয়ে যেত, যেটাকে এখানে বলে ‘বাটি সিস্টেম’। প্রতিদিন দুইবেলা খাবার মেসে দিয়ে যেত, তার বিনিময়ে ৭০ টাকা করে নিত। আমি যেহেতু নতুন ছিলাম, অনেক কিছুই তখনো বুঝে উঠতে পারিনি। তাই বেশি ঝামেলায় না গিয়ে ওই ভাইয়ের পরামর্শে সেখানে খেতে শুরু করি। এরপর মার্চে করোনার সংক্রমণের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে বাড়িতে চলে আসি।

এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে গেছে। আমাদের আসতে হয়েছে ক্যাম্পাসে। কয়েক দিন বাইরে খেলেও আবার আগের মতো ‘বাটি সিস্টেম’ চালু করে দিই, ওখানেই খাওয়া শুরু করি। কিন্তু আগে দুইবেলা খেতে যে ৭০ টাকা লাগত, এখন তা বাড়িয়ে ৭৫ টাকা করেছে তারা। তেলের দামসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হওয়ায় তারা দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে।

এই দুই বছরে করোনায় আমাদের পরিবার বিপর্যস্ত হলেও, আমাদের কোনো আয়ের সুযোগ তৈরি না হলেও, ঠিকই আমাদের ৫ টাকা বেশি দিয়ে খাবার খেতে হচ্ছে। অনেকের কাছে হয়তো ৫ টাকার হিসাবে কিছু মনে হতে না পারে, কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা একজন শিক্ষার্থীর কাছে এটাই অনেক বড় বিষয়। তাঁরা জানেন, এই ৫ টাকা মাস শেষে ১৫০ টাকায় গিয়ে ঠেকবে। তারপর আছে বিদ্যুৎ বিল। আগের চেয়ে প্রায় অনেকাংশে বেশি বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হয় এখন।

আমি যখন বুঝতে শুরু করলাম আমার দুই বেলা খেতে যে টাকাটা চলে যাচ্ছে, তাতে আমার অনেক বেশি খরচ হয়ে যাচ্ছে। ‘বাটি সিস্টেম’ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে খাব, সে রকম কোনো সুযোগও নেই। কেননা, হলের ডাইনিংয়ে প্রায় একই মূল্যে খাবার খেতে হবে। তারপর সাশ্রয়ের কথা চিন্তা করে এক বন্ধুর সুবাদে গত মাস থেকে তাঁর মেসে মিল চালু করে দিই। আপাতত সেখানেই খাচ্ছি। এর মধ্যে আবার তেলের দাম বেড়ে গেছে। নিজেদের চাল কিনতে হয় বলে গতকাল চাল কিনতে গিয়ে জানলাম, চালের দামও ঊর্ধ্বমুখী, নিত্যপণ্যের দাম তো বাড়ছেই।

জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা অনুযায়ী, পুষ্টিচাহিদা মেটাতে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক ২৭০ থেকে ৪৫০ গ্রাম চাল, আটা, ভুট্টা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। ৩০০ থেকে ৬০০ গ্রাম শাকসবজি এবং ১৫০ থেকে ৩৫০ গ্রাম মাছ, মাংস, ডিম খাওয়া উচিত বলে ওই নির্দেশিকা বলছে।

এ ছাড়া সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪৫ মিলি তেল ও চর্বি এবং ৩০ থেকে ৬০ গ্রাম ডাল-জাতীয় খাদ্য একজনকে মানুষের গ্রহণ করা উচিত।

এর সঙ্গে ওই নির্দেশিকায় আরও বলা হয়েছে, একজন মানুষের দৈহিক ও মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে শুধু ভাত-মাছ গ্রহণেই শেষ নয়। এর সঙ্গে খাদ্যতালিকায় দুধ ও দুধ-জাতীয় খাবার দৈনিক ১৫০ থেকে ৪৫০ মিলি, ফলমূল ১০০ থেকে ২০০ গ্রাম এবং চিনি ১৫ থেকে ২৫ গ্রাম গ্রহণ করা উচিত।

কিন্তু আমরা যখন তিনবেলা ভাত খেতে রীতিমতো যুদ্ধ করছি, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে যখন কীভাবে তিন বেলা কিছু খেয়ে পেট ভরানোর কথা চিন্তা করছি, ঠিক তখন আমাদের দৈনিক খাবার গ্রহণের সঙ্গে আমরা নিজেদের পুষ্টিচাহিদা মেটাতে পারছি কি না, এই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।

বিভিন্ন সভা-সমাবেশে মাথাপিছু আয় বাড়ারই শুধু খবর শুনি। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, আমাদের মাথাপিছু আয় গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৯১ ডলার। যা আমাদের দেশীয় মুদ্রায় ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৩৮ টাকা। আমি জানি না, এই মাথাপিছু আয়ের মানে বুঝে কি না সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। আজ সকালে একটা ভিডিও চোখে পড়ল। সেই ভিডিও দেখে প্রথমে মনে হলো, কোনো দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম, আসলে দৌড় প্রতিযোগিতা নয়, টিসিবির পণ্য কিনতে ট্রাকের পেছনে দৌড়াচ্ছে তারা। শেষমেশ পণ্য কিনে তারা সংসার চালানোর দৌড়ে হাঁপিয়ে উঠছে কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন! কেননা, পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে ‘মাস চলে না ৫০ হাজারেও’।

লেখক: শাহরিয়ার সিফাত, শিক্ষার্থী, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।