দেশের ফুটবলের অবস্থা নিয়ে ভাবতে হবে
গোটা বিশ্ব কাঁপছে ফুটবলঝড়ে। দুই মহাদেশে শেষ হলো মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর গণ্ডি পেরিয়ে যার উত্তেজনায় মেতেছিল পুরো বিশ্ব। ফুটবল কতটা জনপ্রিয় খেলা, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পাল্টাপাল্টি যুক্তি এবং তর্ক দাঁড় করিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাগ্যুদ্ধে সময় অতিবাহিত করছেন বিভিন্ন দলের সমর্থকেরা। রাস্তার পাশে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল—সব জায়গাতে চলে ভক্তদের মহারণ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ফুটবল বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা। এশিয়া মহাদেশের হয়েও লাতিন কিংবা ইউরোপের দেশগুলোকে নিয়ে মাতামাতি, যৌক্তিক তর্ক-বিতর্ক, যা আবেগ ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশ অংশগ্রহণ না করলেও ফুটবলের উন্মাদনা যেন অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর থেকে কোনো অংশেই কম না। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে ভ্রমণে এসে এমন পাগলামির ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন। তবে যে দেশটিতে ফুটবল নিয়ে এত আবেগ, মাতামাতি ও উত্তেজনা সে দেশটি ফুটবল বিশ্বে অনেকটাই পিছিয়ে। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে অবস্থান ১৮৪–তে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এ বিষয়ে তেমন কারও মাথাব্যথাও নেই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ থেকে শুরু করে কর্তৃপক্ষও যেন উদাসীন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্য দেশগুলো উন্নতির দিকে এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশের চিত্রটা ঠিক তার বিপরীত।
দিন দিন ঐতিহ্য হারাচ্ছে দেশের ফুটবল। আমাদের দেশের ফুটবলের জৌলুশ-গৌরব, ক্লাব আঙিনায়, মাঠে ফুটবলপ্রেমীদের প্রাণবন্ত উপস্থিতি ও আড্ডা আগের মতো নেই। গ্রামাঞ্চলের খেলা থেকে শুরু করে স্টেডিয়ামে একসময় উপচে পড়া ভিড় হলেও দেশীয় ফুটবলের প্রতি সর্বসাধারণের এতটাই অনীহা হয়ে পড়েছে যে এখন বিনা টিকিটে খেলা দেখার প্রচার-প্রচারণা দিয়েও মাঠে দর্শক টানা কঠিন হয়ে গেছে। পাড়া কিংবা মহল্লায় দেশীয় ক্লাবের পতাকা ওড়ানোর ধুম চোখে পড়ে না। দেশের ফুটবলের অসহায় চিত্র এবং দর্শকদের মাঠের প্রতি আকর্ষণ কমে যাওয়ার জন্য ফুটবল খেলার উন্নয়নে নিবেদিত লোকজনই অনেকাংশে দায়ী।
দেশের ফুটবল সংকটকাল অতিক্রম করছে। ফুটবলের চলমান চিত্রে ফুটবলভক্তরাসহ একসময়ের মাঠ কাঁপানো ফুটবলারদের সোনালি অতীত স্মরণ করে হতাশা ব্যক্ত করতে দেখা যায় প্রায়ই। গত ১০ বছরে ফুটবলের মান বাড়েনি, বরং পেছনের দিকেই হাঁটছে বাংলাদেশ।
দেশীয় ফুটবলের প্রতি ফুটবলপ্রেমীদের আগ্রহ কমেছে জৌলুশ হারানোতেই। অথচ ষাটের দশকেও দেশের ফুটবল সোনালি সময় অতিবাহিত করেছে। প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের কমতি ছিল না। ব্রিটিশ ভারতে দেশীয় ফুটবল খেলা আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। তবে এখন হারিয়ে গেছে ফুটবলের ফেলে আসা সেই সোনালি দিনগুলো। সেই সময়টাতে প্রিয় দল, প্রিয় খেলোয়াড়ের খেলা দেখার জন্য কাকডাকা ভোর থেকে ঢাকা স্টেডিয়ামের টিকিট কাউন্টারে ফুটবলভক্তরা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকত টিকিটের জন্য। ফুটবলপাগল দর্শকদের টিকিট হাতে পাওয়া মাত্র খুশিতে আত্মহারা হয়ে স্টেডিয়ামে প্রবেশের জন্য ফটকপানে ছোটা, উৎফুল্লচিত্তে স্টেডিয়ামে প্রবেশের চিত্র ছিল দেখার মতো। তবে বর্তমানে দেশের ফুটবলের প্রতি মানুষের অনাগ্রহ দুঃখজনক। যদিও দেশীয় ফুটবলের এই দুরবস্থার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই দায়ী। বড় ধরনের বাজেটের পরও ফুটবলের উন্নয়নে নেই যথাযথ পরিকল্পনা। মাঠের দুরবস্থার চিত্র তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ ছাড়া বিশ্বমানের খেলোয়াড় তৈরি করতে না পারা, প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের যথাযথ মূল্যায়ন না করা, উন্নত মানের সরঞ্জাম, ব্যায়ামাগার করতে না পারা, যা অন্যদের থেকে পিছিয়ে দিচ্ছে আমাদের।
বাংলাদেশ এখন এশিয়ার কোনো একটি দেশের সঙ্গে ড্র করতে পারলেই যেন আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়। অথচ ভক্তদের চাওয়া আরও অনেক বেশি। এশিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ব ফুটবলে দাপিয়ে বেড়াবে, এমনটাই প্রত্যাশা। ভিন্ন দেশের সমর্থন করতে গিয়ে লড়াই না করে একদিন পুরো জাতি এক হয়ে নিজ দেশের জন্য গলা ফাটাবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উপস্থাপিত হবে দেশীয় ফুটবলের রূপকথার গল্প।
আর সে জন্য কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ জরুরি। তৃণমূল পর্যায় থেকেই প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের বের করে আনতে হবে। তাঁদের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচর্যা করতে হবে। দেশের মাঠগুলোর বেহাল দশা দূরীকরণ এবং উন্নয়নের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিশ্ব মানের কোচ, আধুনিক ব্যায়ামাগার এবং সরঞ্জামের ব্যবস্থা করতে হবে। মানহীন বিদেশি খেলোয়াড়দের পরিবর্তে দেশীয় প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের বেশি সুযোগ দিতে হবে। ক্লাব ফুটবল গুলোর উন্নয়নে ব্যাপকভাবে তদারকি করতে হবে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সবার সার্বিক সহযোগিতা জরুরি। বাংলাদেশের ফুটবলের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে এবং ঐতিহ্য রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশও একদিন ফুটবল বিশ্বে সফলতার প্রতীক হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা দখল করবে।
*লেখক: মামুন হোসেন, শিক্ষার্থী ঢাকা কলেজ, ঢাকা।