দেশ কখন ব্যর্থ হয়
পৃথিবীতে কিছু কিছু দেশ কেন এত সমৃদ্ধিশালী ও ধনী, আর কিছু কিছু দেশ কেন এত গরিব কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতায় পরিপূর্ণ? কেন যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো ধনী ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, আর সিয়েরা লিওন, হাইতি, কঙ্গো কিংবা উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলো আটকে থাকে দারিদ্র্যে? কেন অতি শক্তিশালী যেমন প্রাচীন রোম থেকে শুরু করে আধুনিক সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো দেশগুলোর পতন ঘটে? এসব বিষয় নিয়ে লেখালেখি ও গবেষণা চলছে বহুদিন ধরে। আজ থেকে দুই শতাব্দীরও বেশি সময় আগে স্কটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ বিষয়টির ওপর আলোকপাত করতে চেয়েছিলেন তাঁর ‘অ্যান ইনকোয়ারি ইনটু দ্য নেচার অ্যান্ড কোজেস অব দ্য ওয়েলথ অব নেশনস’ বইটিতে। ১৯১৯ সালে জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার যুক্তি দিয়েছিলেন, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিকগত পার্থক্যের কারণে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিস্তৃত বিভিন্ন অর্থনৈতিক পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। আবার অনেকের মতে, প্রাকৃতিক সম্পদ বা প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব দরিদ্র দেশগুলোকে স্বনির্ভর টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তৈরি করতে বাধার সৃষ্টি করেছে।
২০১২ সালে এই একই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন ড্যারন এসিমগলু ও জেমস এ রবিনসন নামের দুই অর্থনীতিবিদ। তাঁদের প্রায় ১৫ বছরের গবেষণায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর তিন শতাধিক গবেষণাকর্ম বিশ্লেষণ করে তাঁরা ‘হোয়াই নেশনস ফেল: দ্য অরিজিনস অব পাওয়ার, প্রসপারিটি অ্যান্ড পভার্টি’ বইটি প্রকাশ করেন ওই বছর। তাঁরা বলছেন, এর কারণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। তাঁদের মতে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের চরিত্রের মধ্যেই কোনো দেশের উত্থান বা পতনের কারণ নিহিত থাকে। বিভিন্ন দেশের সম্পদের বা উন্নতির এ পার্থক্যের পেছনের প্রচলিত বা চিরাচরিত যুক্তি, যেমন: ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিকগত পার্থক্য, প্রাকৃতিক সম্পদের স্বল্পতা বা প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব, অশিক্ষিত নেতৃত্ব কিংবা ভৌগোলিক অবস্থান—এসব বিষয় যে দায়ী, তা মানতে নারাজ তাঁ। তাঁর কথা হচ্ছে,এর পেছনের মূল কারণ বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। তাঁরা এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। এক গকে তাঁ বলছেন এক্সট্রাক্টিভ বা নিষ্কাশনমূলক। সহজ বাংলায় সরাসরি বলতে গেলে বলা যায় শোষণমূলক। আর আরেক ভাগকে তারা বলছেন ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক। সহজ বাংলায় যাকে বলা যায় অংশগ্রহণমূলক।
এবার আরেকটু বোধগম্য হওয়ার জন্য দেখি তাঁরা এই দুটোর মানে কী বোঝাতে চেয়েছেন। ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বলতে তারা ওই সব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে বুঝিয়েছেন, যারা সাধারণত ক্ষমতার ভাগাভাগি, উৎপাদনশীলতা, শিক্ষা, প্রযুক্তিগত অগ্রগতিসহ সামগ্রিকভাবে জাতীয় কল্যাণের ওপর জোর দেয়। সবার রাজনৈতিক অধিকার ও বেসরকারি সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করে। সমাজের বৃহত্তর অংশকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় জড়িত করে তাদের অধিকার বুঝিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে চলে এ ধরনের অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান। এ অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের নিশ্চয়তা এবং চুক্তি আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বিনিয়োগ ও উদ্ভাবনের জন্য প্রণোদনা তৈরি করে। শিক্ষা এবং অবকাঠামোগত সুবিধা সরবরাহের মাধ্যমে বিনিয়োগ এবং প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে। সবার জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করে, নতুন প্রযুক্তি এবং দক্ষতায় বিনিয়োগ করার পাশাপাশি সামগ্রিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন নিশ্চিত করে। রাষ্ট্র মূলত নাগরিক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং একশ্রেণির মানুষের (মূলত এলিট শ্রেণি) উপকারের জন্য কাজ করার পরিবর্তে বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষে কাজ করে। অর্থাৎ এখানে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা বলা হচ্ছে। আর এই ব্যবস্থায় যদি তারা এসব করতে ব্যর্থ হয়, তখন জনগণ তাদের ভোটের মাধ্যমে সরিয়ে দেয়। আর উন্নত দেশগুলো এই ধরনের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ধীরে ধীরে হয়েছে সমৃদ্ধিশালী ও ধনী। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশেই রয়েছে এ ব্যবস্থা।
অন্যদিকে, এক্সট্রাক্টিভ বা নিষ্কাশনমূলক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে রাজনৈতিক নীতিনির্ধারণ ও আয় বণ্টনের প্রক্রিয়া থেকে বের করে দেয়। আর এ কাজ করে তারা দমন ও পীড়নের মাধ্যমে। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক অধিকার আর ক্ষমতা দীর্ঘদিন ধরে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির কাছে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় সমাজের বৃহত্তর অংশ থেকে সম্পদ নির্দিষ্ট এক শ্রেণির হাতে চলে যায়। রাষ্ট্র পরিচালিত হয় স্বৈরশাসক ও তাদের সহযোগী দ্বারা। এতে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো হয়তো কখনো কখনো স্বল্পমেয়াদি প্রবৃদ্ধি ঘটায়, কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল হয় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক দারিদ্র্য ও জীবনমানের অনগ্রসরতা।
এসব এক্সট্রাক্টিভ বা ইনক্লুসিভ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতির কিংবা অনুপস্থিতির ওপর নির্ভর করে একটি দেশের ক্রমে সমৃদ্ধিশালী বা শক্তিশালী হওয়া অথবা দরিদ্র কিংবা দুর্বল হওয়া। কারণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা সাপোর্টেড হতে হয়। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক ক্ষমতাকে একটি প্লুরালিস্টিক বা বহুত্ববাদী উপায়ে বণ্টন করে, যাতে কিছুটা রাজনৈতিক কেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, যেটি আবার মালিকানার অধিকার এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বাজার অর্থনীতির পূর্বশর্ত। অন্যদিকে, শোষণমূলক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে তাদের মতো করে লুণ্ঠনকারী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে রাষ্ট্রক্ষমতা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য।
তাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সফলতা ও ব্যর্থতার উদাহরণ দিয়েছেন। তাঁরা একটি দেশের কিংবা রাষ্ট্রের সফলতা অথবা ব্যর্থতাকে দেখছেন দেশটির অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় কিংবা সমন্বয়হীনতার ফল হিসেবে। তাঁদের দাবি, অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক উপস্থিত থাকলেও দুটি দেশের মধ্যকার পার্থক্য প্রধানত তৈরি হয় তাদের বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। একই ভৌগোলিক অবস্থান কিংবা সাংস্কৃতিক ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও পাশাপাশি অবস্থিত অনেক দেশের ক্রমশ বিসদৃশ উন্নতির পেছনে রয়েছে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈশিষ্ট্য। উত্তর কোরিয়ার তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়ার ক্রমে উন্নতির পেছনে রয়েছে একই কারণ।
চল্লিশের দশকে এই দুই দেশের উন্নতি ছিল প্রায় একই রকম। কিন্তু বর্তমানে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থানের মিল নেই। দক্ষিণ কোরিয়ার জীবনযাত্রার মান উত্তর কোরিয়ার চেয়ে দশ গুণ বেশি। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং বাজার ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করেছিল। যার ফলে ওই দেশে বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথ অনেকটা সুগম হয়েছিল। সরকার শিক্ষায় বিনিয়োগ করেছিল এবং নতুন নতুন শিল্পকারখানা এই উন্নত শিক্ষিত জনগোষ্ঠী থাকার একটা সুফল পেয়েছিল। অন্যদিকে, উত্তর কোরিয়ায় নীতি ছিল নিষ্কাশনমূলক। ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং মুক্ত বাজার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। একটি নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক নীতির কারণে দেশটি কেবলই স্থবিরতার দিকে এগিয়েছে।
একই অবস্থা হয়েছে আফ্রিকার অনেক দেশে। কঙ্গোর কথাই ধরি। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কঙ্গো চরম দারিদ্র্যে নিমজ্জিত হয়েছিল প্রেসিডেন্ট জোসেফ মবুতুর শাসনামলে। তাঁর শাসনপদ্ধতি ছিল চরমভাবে এক্সট্রাক্টিভ। প্রায় ৩০ বছরের স্বৈরশাসন আমলে তিনি শোষণমূলক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। রাজনৈতিক বিরোধী প্রতিপক্ষকে চরমভাবে দমন করেছিলেন তিনি। সাধারণ জনগণ কেবলই গরিব হচ্ছিল আর মবুতু আর তাঁর এলিট সাঙ্গোপাঙ্গরা কেবলই ধনী হচ্ছিল। মবুতু রাষ্ট্রের টাকায় নিজের জন্মস্থান নিজের জন্য এমন একটি ভবন নির্মাণ করেন, যেখানে সুপারসনিক জেট অবতরণের মতো ব্যবস্থা ছিল। তিনি যেটা প্রায়ই ইউরোপ ভ্রমণের সময় এয়ারফ্রান্স থেকে ভাড়া নিতেন। ইউরোপেও তিনি প্রচুর সম্পত্তি কেনেন নিজের জন্য। মবুতু আর তাঁর দোসরদের কঙ্গোর উন্নয়নের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। তাঁরা কঙ্গোর খনিজ সম্পদ ব্যবহার করেছেন নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নয়নে। লেখকদ্বয় তাঁদের নাম দিয়েছেন ‘ভ্যাম্পায়ার ক্যাপিটালিস্ট’। আর তাঁদের পক্ষে এগুলো করা সম্ভব হয়েছিল শোষণমূলক নীতির কারণে।
জিম্বাবুয়ে, সিয়েরা লিওন, ক্যামেরুন, চাদ, হাইতি, লাইবেরিয়া, সুদানসহ আফ্রিকার আরও অনেক দেশের একই অবস্থা এই কারণেই। গৃহযুদ্ধ, গণ–উৎখাত, দুর্ভিক্ষ আর মহামারির কারণে ওই সব দেশে আগের চেয়েও হয়েছে আরও দরিদ্র। একই অবস্থা আর্জেন্টিনা, আফগানিস্তান, মিসর কিংবা কলম্বিয়ার। ওই সব দেশে সঞ্চয়, বিনিয়োগ কিংবা উদ্ভাবনের জন্য কোনো প্রণোদনা নেই। কারণ, ওই একই শোষণমূলক নীতি। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইনক্লুসিভ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে দমন করে রেখেছে, কারণ এগুলোকে তারা তাদের ক্ষমতার জন্য হুমকিস্বরূপ মনে করে। জিম্বাবুয়ে বা সিয়েরা লিওনের মতো দেশগুলো আজ সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ ওই একই কারণে।
ইনক্লুসিভ প্রতিষ্ঠানগুলো গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মতপ্রকাশ এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সমন্বয়মূলক ও পরিকল্পিত উন্নয়নের পথে নিয়ে যায় দেশকে। এতে ভোটাধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের অধিকারকে পাহারা দেয় এবং এর ফলে ক্ষমতাসীন এলিটদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। মোদ্দাকথায়, ওই ব্যবস্থায় বিরাট জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত থাকে বলে টেকসই উন্নয়নও সম্ভব হয়।
তাঁরা তাদের আলোচনায় অথোরিটারিয়ান শাসনে কিছু কিছু দেশ যে উন্নতি করেছে, বিশেষ করে চীনের কথাও এনেছেন। এই ব্যাপারে তাঁদের কথা হলো নিষ্কাশনমূলক শাসনব্যবস্থায় চীন উন্নতি করেছে, কিন্তু তা হয়তো সাময়িক।
তাদের মতে, চীনের এই প্রবৃদ্ধি টেকসই নয়, কারণ এটি ‘ক্রিয়েটিভ ডেস্ট্রাকশন’কে প্রোমোট করে না। অথচ এটি উদ্ভাবন এবং উচ্চ আয়ের জন্য অতীব জরুরি। টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দরকার প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উদ্ভাবন। আর এই উদ্ভাবনই ক্রিয়েটিভ ডেস্ট্রাকশনের মূল সূত্র। চীন যতক্ষণ পর্যন্ত না ক্রিয়েটিভ ডেস্ট্রাকশন স্টেজে নিজেদের উত্তরণ ঘটাতে পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত চীন তার প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে পারবে না। লেখকদ্বয় দাবি করেন, চীনে কি এটা সম্ভব যে বিশ বছর বয়সী একজন কলেজ ছেড়ে দেওয়া ছেলে নতুন একটা কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে এবং তার মাধ্যমে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের অর্থায়নে রাষ্ট্রীয় কোম্পানিভিত্তিক গোটা ব্যবস্থাকেই চ্যালেঞ্জ করবে? তাঁদের মতে, চীন কমিউনিস্ট পার্টির স্বেচ্ছাচারী হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এক্সট্রাক্টিভ প্রতিষ্ঠানের দ্বারা প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতাকে একচেটিয়াভাবে কুক্ষিগত করতে পেরেছে এবং ব্যাপক পরিসরে সম্পদের সঞ্চালন করতে পেরেছে বলেই মূলত চীন একটি উচ্চমাত্রার প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছে।
তাঁরা আবার এটাও বলেছেন, চীনের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন অনেকটাই ইনক্লুসিভ, যা তিন দশক আগেও ছিল না। যাহোক, চীনের এই অনন্য উন্নতির কারণে তাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কোনো দেশের জন্য মডেল হতে পারে না, সেটাও তাঁরা বলেছেন। কারণ, চীনের বিষয়টা একেবারেই আলাদা। মাও সে তুংয়ের মৃত্যুর পর যে সাময়িক রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, ওই সময় চীন তা ভালোভাবেই সামাল দিতে পেরেছিল কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে। আর তাই চীনে অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রণোদনা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থেকেই এসেছিল। এই রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে সমন্বয় চীন করতে পেরেছে, সেটা অন্য কোনো রাষ্ট্র করতে পারবে না সহজে। চীনে ষাটের দশকের বিপ্লবের হানাহানি বন্ধ হয়েছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই। স্বেচ্ছাচারী হলেও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সেখানে দুর্নীতির প্রধান অন্তরায়।
তা ছাড়া চীনের অর্থনীতি উৎপাদনমুখী, যেখানে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের এক্সট্রাস্টিভ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় বেশির ভাগের অর্থনীতি অনেকটাই আত্মসাৎমুখী।
বইখানার শেষের দিকে তাদের কিছু পরামর্শ রয়েছে। একটি দেশের উন্নয়নের জন্য দরকার সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ। দেশ পরিচালনায় কারা থাকবেন, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে জনগণের হাতে। সর্বস্তরের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন থাকবে রাজনৈতিক কাঠামোতে। জনগণ সেটি প্রয়োগ করবে নির্বাচনের মাধ্যমে। আর সেই নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। নিশ্চিত করতে হবে নাগরিকের ক্ষমতায়ন, সংবাদপত্র ও প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা। আর এ সবকিছু নিশ্চিত না করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোনো চেষ্টাই আসলে সুদূর প্রসারী কোনো ফলাফল বয়ে আনবে না। একটি কার্যকর নির্বাচনব্যবস্থার অনুপস্থিতি কেবল একটি দেশের জন্য রাজনৈতিক দুর্ভাগ্য নয়, একটি বিরাট জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক বঞ্চনার কারণও বটে। আর ইতিহাসের শিক্ষা হলো যথার্থ রাজনীতি কিংবা রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত না হলে অর্থনীতিও সঠিক হবে না।
*লেখক: চৌধুরী শাহেদ আকবর, কলামিস্ট