দুই বন্ধু এক দেশ
শ্রাবণের দিনগুলো। ঝিরঝির করে সকাল থেকে বৃষ্টি। করোনার আতঙ্ক। মানুষের জীবন হয়ে উঠছে ভীষণ অন্য রকমের। গ্রাম থেকে ছুটছে শহরে। অগণিত মানুষ আর মানুষ। ভোগান্তিতে বাস–লঞ্চ–ট্রাকে। হাসপাতালগুলোতে রোগীসংখ্যা এখন ১০ গুণ। তারপরও জীবন তো থেমে নেই। চলছে আপন গতিতে। ক্যাম্পাস কবে খুলবে, সেই প্রতীক্ষায় বসে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে কত দিন দেখেননি। খোঁজখবর, সামাজিক মাধ্যমে যোগাযোগ মাত্র। তা নিয়ে আর কত দিন!
আজ আগস্টের ১ তারিখ, প্রথম রোববার। বিশ্ব বন্ধু দিবস। এই দিবসে ক্যাম্পাস খোলা থাকলে হয়তো জমে উঠত বন্ধুত্বময় আড্ডা। এই বন্ধু দিবসে বিশ্বের ইতিহাসে অনবদ্য ইতিহাস হয়ে থাকা ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। তারও আজ ৫০ বছর। সুবর্ণজয়ন্তী। করোনা না থাকলে হয়তো দিনটি পালন করা হতো বিরাট জমজমাট করে।
১৯৭১ সালের ১ আগস্ট, ২০২১ সালের ১ আগস্টের মিল শুধু যে রোববারটি, এমনটি নয়। ৫০ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশে হয়তো সেই দিনের মতো গণহত্যা নেই, মানুষের উদ্বাস্তু জীবন নেই, অনাহারের আর্তনাদ নেই। তবে আছে উৎকণ্ঠা, বৈষম্য, মানুষের প্রচণ্ড অস্থিরতা। এর অস্থিরতার মধ্যে আমি আর আমার বন্ধু প্রিয়জিৎ দেবসরকার খুঁজতে থাকি একাত্তরের ১ আগস্টের ঘটে যাওয়া ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশে’র ইতিহাস। প্রিয়জিৎ দেবসরকার একজন অ–বাংলাদেশি। কিন্তু প্রচণ্ড ভালোবাসা তাঁর বাংলাদেশের প্রতি, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি। প্রায় আট বছরের সম্পর্ক। দাদা বলে সম্বোধন করি। ভারতের কলকাতায় জন্ম। যুক্তরাজ্যের নাগরিক। বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের পরিকল্পনা ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে নতুন করে তুলে ধরা। কীভাবে এই কনসার্ট আয়োজন করা হলো? ওই সময়ে পত্রিকাগুলোতে কেমন প্রচারণা ছিল—কোথাও কোনো আর্কাইভে এই নিয়ে জমা আছে কি না কোনো তথ্য। তারপর বের হতে থাকে নানা অজানা কথা। সেগুলো নিয়ে দুই বন্ধু মিলে আমরা প্রকাশ করতে যাচ্ছি ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ: দুই বন্ধু এক দেশ’।
দুই বন্ধুর বন্ধুত্ব
কীভাবে পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের বন্ধুত্ব হলো। একজন ভারতীয়। আরেকজন যুক্তরাজ্যের। একজন সেতারবাদক। আরেকজন গিটারিস্ট ও সংগীতশিল্পী। দুইজনেই সাংস্কৃতিক ও মানবিক কর্মী। জর্জ হ্যারিসন কয়েকবার ভারতে আসেন। এই আসা–যাওয়ার কারণে ভারতীয় দর্শন তাঁকে আকর্ষণ করে। তাই ভালোবেসে ১৯৬৫ সালের মাঝামাঝি সময় রবিশঙ্করের কাছে শুরু করেন সেতারবাদন। তখনই মনে হয় তাঁদের বন্ধুত্ব হয়। জানা যায়, ১৯৬৮ সালে জর্জ হ্যারিসন বুঝতে পারেন সেতারবাদক হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে কি গুরুর সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে? তা নয়, বরং সেই সম্পর্ক হয়ে ওঠে অমরত্ব। দুই বন্ধু মিলে সৃষ্টি করেন এক অনবদ্য ইতিহাস, যা বাংলাদেশের মানুষ আজীবন মনে রাখবে।
বীর মুক্তিযোদ্ধারা আপ্রাণ যুদ্ধ করে যাচ্ছেন দেশকে শত্রুমুক্ত করতে, স্বাধীন করতে। চারদিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অসহ্য নির্যাতন, গণহত্যা, ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড। ভারতে এক কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে দুর্বিষহ জীবনযাপন। নিয়মিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, রেডিওতে প্রচারিত হচ্ছে এসব সংবাদ। বাংলাদেশের নড়াইলের কালিয়ায় যাঁর পৈতৃক ভিটা, তিনি কি এমন দুর্দশার কথা শুনে স্থির থাকতে পারেন। কেউ যেমন পারে না, রবীন্দ্র শঙ্কর চৌধুরী ওরফে রবিশঙ্করও পারেননি। মনঃকষ্টে ভুগতে ভুগতে তিনি ভাবলেন, ‘ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের দুর্ভোগ লাঘব ও জনগণকে সহায়তা কীভাবে করা যেতে পারে।’
সেই সময় জর্জ হ্যারিসনের ব্যান্ডদল বিটলসে চলছে ভাঙাগড়া। হ্যারিসন তখন নিজেও রেকর্ডিং নিয়ে ব্যস্ত। কারণ, বিটলসে ভেঙেছে। জীবন তো চলবে, তাই তিনি জীবনকে নতুনভাবে সাজানোর জন্য ব্যস্ত। তাঁর রাগা অ্যালবামের জন্য লস অ্যাঞ্জেলেসে কাজ করেছিলেন।
এর মধ্যে বন্ধু রবিশঙ্কর পাঠালেন মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অমানবিক নির্যাতনের বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রকাশিত খববের কাটিং। আর বললেন, অর্থ সংগ্রহের জন্য তহবিল গঠনের সহায়তা। এর জন্য করবেন কনসার্ট। জর্জ হ্যারিসনকে পাশা থাকা। হ্যারিসন মনে করলেন, রবিশঙ্করের পাশে থাকা উচিত।
জর্জ হ্যারিসন তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ আই মি মাইন লেখেন, ‘বিষয়টি কী, আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করলাম। আমার মনে হলো, কাজটার ব্যাপারে আমার বোধ হয় তাকে সাহায্য করা উচিত।’
তারপর দুই বন্ধু জড়িয়ে পড়লেন বাংলাদেশের মানুষের জন্য অর্থ সংগ্রহ তহবিল গঠনের জন্য কনসার্ট। যা হয়ে ওঠে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। এ সম্পর্কে জর্জ হ্যারিসন তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে লেখেন, ‘সামান্য মহড়াই আমরা করেছিলাম। সত্যি বলতে কি, সবার উপস্থিতিতে একটা মহড়া আমরা করতে পারিনি। নানা অসুবিধার মধ্যে অগোছালোভাবে কাজটা করলাম আমরা।...তারপর কনসার্ট করলাম আমরা। দুটি অনুষ্ঠান করেছিলাম। প্রথম অনুষ্ঠানের সব টিকিট বিক্রি হয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয় কনসার্টটি করেছিলাম। কপালই বলতে হবে, সবকিছু ভালোয় ভালোয় সম্পন্ন হয়েছিল।’
পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের পারস্পরিক বন্ধুত্বের জন্য এমন দুটি কনসার্টের আয়োজন করা সম্ভব হয়েছিল। দুটি বললাম এ জন্য, প্রথম কনসার্টটি বেলা আড়াইটায় অনুষ্ঠিত হলে দর্শকের চাপে রাত আটটায় আবার কনসার্টের আয়োজন করতে হয়। এই আয়োজন বিশ্বখ্যাত তারকারা সংগীত পরিবেশন করলেন। যুক্তরাষ্ট্রের বব ডিলানের মতো বিখ্যাত তারকা সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে সারা বিশ্ব জানতে পারলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ পাশে আছে।
পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের বন্ধুত্ব আজীবন ছিলেন। ২০০১ সালে জর্জ হ্যারিসন ও ২০১২ সালে পণ্ডিত রবিশঙ্কর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলও তাঁদের বন্ধুত্বের কথা অম্নান হয়ে থাকবে বিশ্বের ইতিহাসে। বাঙালির হৃদয়ে। কনসার্ট ফর বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী ও বন্ধু দিবসে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা, অকুণ্ঠ ভালোবাসা।
আবু সাঈদ : কবি, লেখক ও সংগঠক