ত্রাণ নয়, প্রাণের দাবি টেকসই বেড়িবাঁধ

‘ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে, এইখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’ আমার মনে হয় বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল আশাশুনি (প্রতাপনগর) কয়রা-শ্যামনগরের মতো অবহেলিত অঞ্চলের কথা ভেবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এসব কথা বলেছিলেন। আশাশুনির প্রতাপনগরের মাটিতে বেড়ে ওঠা সন্তান হিসেবে দেখেছি, তিলে তিলে অনুভব করেছি, জীবন সেখানে কতটা বিষাদময়। আপনারা যাঁরা এ অঞ্চলে এসেছেন, তাঁরা জানেন, সেখানকার মানুষের জীবন ধারণ কেমন। অধিকাংশ মানুষ কৃষক, দিনমজুর, ভ্যানচালক, মাছচাষি। কেউ কেউ আবার জেলে, যাঁরা সুন্দরবনের বাঘের সঙ্গে লড়াই করেন জীবিকার প্রয়োজনে। আবার অনেকেই চলে যান বঙ্গোপসাগরে পরিবারের মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবার তুলে দিতে। সেই সকাল থেকে শুরু করে সারা দিন হাড়ভাঙা শ্রমের কাজগুলো তাঁরা করেন।

তাঁরা বাস করেন মাটি, কাঠ, টিন বা গোলপাতার তৈরি ঘরে। সময়ের সঙ্গে সংগ্রাম করেই তাঁদের দিনাতিপাত করতে হয়। তবু তাঁদের কপালে সুখের লেশমাত্র নেই। প্রতিনিয়ত স্বপ্নভঙ্গ, আশা নষ্টের খেলায় তাঁরা অভ্যস্ত হয়ে যেতে বাধ্য। কখনো আইলা, কখনো সিডর, কখনো নার্গিস, কখনো আম্পান, কখনো ইয়াস...এভাবে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পিষ্ট হয়ে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন নাভিশ্বাস হয়ে উঠেছে।

প্রতিবারই যখন কোনো দুর্যোগের আবির্ভাব হয়, লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায় কপালফাটা এসব মানুষের স্বপ্নের সাজানো সংসার। জীবন ও সম্পদের এত পরিমাণ ক্ষতি মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তবু জীবনের প্রয়োজনে সামলে নিতে হয় সবকিছু। জীবন যেখানে যেমন। এ অঞ্চলের মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় অভিশাপ হলো নদীভাঙনের খেলা। সর্বনাশা নদীর পানির স্রোতের সঙ্গে ভেসে যায় এ অঞ্চলের মানুষের বহু দিনের লালিত রঙিন স্বপ্নগুলো, লোনাপানির নিচে তলিয়ে যায় সুখের ঠিকানা।

নদীর জোয়ারের পানিতে ভেঙে পড়ে মানুষের ঘর, টিনের চাল, ভেসে যায় গোলপাতার ছাউনি।

এই মুহূর্তগুলোর অনুভূতি কথায় কিংবা লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সেটি ভুক্তভোগী মানুষমাত্রই জানেন। ওই মুহূর্তগুলোয় মানুষের জীবন বাঁচানোই একমাত্র চেষ্টা হয়ে পড়ে। চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যায় কত বৃদ্ধ কিংবা শিশুর লাশ, গরু-ছাগল-হাস-মুরগি কিংবা গৃহপালিত পশুপাখির তাজা জীবন, দামি আসবাবপত্র, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, উপড়ে যায় গাছপালা, ভেসে যায় খেতের শস্য, ঘেরের মাছ ইত্যাদি। এমনকি শিক্ষার্থীদের বইখাতাগুলোও ভেসে যায় জোয়ারের পানিতে।

একটি নির্দিষ্ট স্তূপ কিংবা দ্বীপের মতো ভূমির ওপর কাটাতে হয় জীবন, যার একপাশে ভেসে এসে লেগে থাকে মরা লাশ, অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে খেতে বসতে হয়, যেদিকে বসে শারীরিক বর্জ্য ত্যাগ করতে হয়। ভিটার ওপরে বসে কাটাতে হয় জীবন, যার চারপাশে বিষাক্ত জলরাশি। একটা কুঁড়েঘরে গরু-ছাগল-মানুষের বাস। যে পানিতে গোসল, সে পানিতে প্রস্রাব-পায়খানা, সে পানিতেই দৈনন্দিন কাজকর্ম। সাপ, পোকা, বিচ্ছুর ভয় পেয়ে লাভ নেই। নির্ঘুম রাত কাটে এই দুশ্চিন্তায় যে কখন কী ঘটে যায়…!

এ অসহনীয় পরিস্থিতিকে পুঁজি করে একশ্রেণির মানুষের চলে রাজনীতি, পেটনীতি কিংবা স্বজনপ্রীতি। জনপ্রতিনিধিরা সুন্দর সুন্দর বুলি দিয়ে সহজ–সরল মানুষের বোকামির সুযোগ নিয়ে থাকেন। কেউ কেউ জনপ্রতিনিধিদের গালমন্দ করার আড়ালে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টায় মত্ত থাকেন। কেউ কেউ এ দুর্ভোগকে ব্যবহার করে ভোগে পরিণত করেন। এই ধরুন পানি বিক্রি, খাদ্য বিক্রি, মাছ ধরা, মিডিয়া গরম করা ইত্যাদি। তাহলে সিংহভাগ মানুষের দুর্ভোগ থেকেই যায়।

এ অবস্থার বিবেচনায় ওপর মহলে কিছু বাজেট কিংবা সুপারিশ তৈরি হয়। বেশ কিছু দিন ধরে চলে তার আভাস। তারপর ঝড় থেমে যায়, আমও পড়ে না আর। নেতা-কর্মীদের অবস্থার উন্নয়নে সেসব বাজেট সংকুলান হয় না, সাধারণ মানুষের ভাগ্যে পৌঁছাবে কী করে? এ দেশে দলীয়করণ করা একটি পেশাগত আদর্শে পরিণত হয়েছে। ঝড়ের সিগনাল কেটে যায়, নেতাদের বেড়িবাঁধ কর্মকাণ্ডের ইতি ঘটে। আবার নতুন দুর্যোগ পরিস্থিতি তৈরি হলে নেতাদের ঘোরাঘুরি হাবভাব এমন বৃদ্ধি পায় যেন মনে হবে তাঁরাই জনগণের যোগ্য ও একনিষ্ঠ সেবক। তবে ভোটের এ সময় এসব অসহায়ত্বকে ইস্যু করে ফয়দা লোটার জুড়ি নেই নেতাদের।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সুরে বলতে চাই, ‘আমরা কী রকমভাবে বেঁচে আছি আপনারা এসে দেখে যান নেতা–মন্ত্রীরা। একি মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা, নাকি জীবন এবং আশার মাঝে হারা–জেতার খেলা?’ ২০০৭ সাল থেকে দেখে আসছি এ দুর্বিষহ পরিস্থিতি। আমার পূর্বপুরুষেরা হয়তো আরও আগে থেকে দেখে আসছেন। দীর্ঘ ১২ থেকে ১৪ বছর যাবৎ এ অঞ্চলের মানুষের অবকাঠামো পরিবর্তনের মিথ্যা আশ্বাস শুনে আসছি, আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। একটি কথা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, ত্রাণ নয়, টেকসই বেড়িবাঁধ চাই। জানি না আদৌ হবে কি না। তবু আশায় বুক বেঁধে বেঁচে আছি। এভাবেই হয়তো জীবন শেষ হয়ে যাবে। এরপর কোনো এক যুগে হয়তো পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চল।

* মো. আবু সাঈদ, শিক্ষার্থী, গ্র্যাজুয়েট’স মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কয়রা, খুলনা