তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি চোর বটে
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচক নিয়ে চারদিকে চলছে আলোচনার ঝড়। এটা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায়ই টিআই দুর্নীতিসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। যথারীতি এক পক্ষ এ নিয়ে সংক্ষুব্ধ হয় এবং এসব প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে। এই যেমন, ২০২০ সালের প্রতিবেদন নিয়ে একজন মন্ত্রী মহোদয় মন্তব্য করেছেন, ‘পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে দুর্নীতি বেশি, এটা পাগলেও বিশ্বাস করবে না।’ বছর দুয়েক আগে দুর্নীতি দমন কমিশন বলেছিল, দুর্নীতির ধারণা সূচক তৈরির পদ্ধতি সঠিক নয়। যদিও টিআইয়ের দাবি, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতিতেই দুর্নীতির এই ধারণা সূচক তৈরি করা হয়। ব্যাপারটা আসলে কী?
বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান টিআই প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির তুলনামূলক চিত্র ‘দুর্নীতি ধারণা সূচক’ (সিপিআই) প্রকাশ করে থাকে। ১৯৯৫ সাল থেকে তারা নিয়মিতভাবে এই সূচক প্রকাশ করে আসছে। ইতিমধ্যে সিপিআই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দুর্নীতির পরিমাপক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মূলত সরকারি খাতের দুর্নীতি নিয়ে অংশীজনদের মনোভাবের প্রতিফলন হয় দুর্নীতির ধারণা সূচকে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধি করার প্রচেষ্টাকে দুর্নীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয় সিপিআই তৈরিতে। বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন এবং বিভিন্ন জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে এই সূচক তৈরি করা হয়। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য এবং নিরপেক্ষ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন: বিশ্বব্যাংক, দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, দ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ইত্যাদি কর্তৃক পরিচালিত জরিপ সিপিআই তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম তিনটি সূত্র থেকে প্রাপ্ত জরিপের তথ্য বিবেচনায় নেওয়া হয়।
মোট ছয়টি তথ্যের ভিত্তিতে সিপিআই নির্ণীত হয়। এগুলো হলো দুর্নীতি ও ঘুষ আদান-প্রদান; স্বার্থের সংঘাত ও তহবিল অপসারণ; দুর্নীতিবিরোধী উদ্যোগ ও অর্জনে বাধা; ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক দলের স্বার্থে সরকারি পদমর্যাদার অপব্যবহার; প্রশাসন, কর আদায়, বিচার বিভাগসহ সরকারি কাজে বিধিবহির্ভূত অর্থ আদায় এবং অনিয়ম প্রতিরোধ ও দুর্নীতি সংঘটনকারীর বিচার করতে সরকারের সামর্থ্য, সাফল্য ও ব্যর্থতা। ১০০ ভিত্তির এই সূচকে শূন্য স্কোরকে দুর্নীতির ব্যাপকতার ধারণায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ১০০ স্কোরকে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত বা সর্বোচ্চ সুশাসনের দেশ হিসেবে বিবেচনা করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। আগে ১০–ভিত্তিক সূচকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতি তুলে ধরা হলেও ২০১২ সাল থেকে ১০০ ভিত্তির এই সূচক প্রকাশ করা হচ্ছে। অর্জিত ফলাফলের ভিত্তিতে দুর্নীতির ক্রম অনুসারে দেশগুলোর একটি তালিকা তৈরি করা হয়, যেখানে কম দুর্নীতিপরায়ণ দেশগুলো থাকে ওপর দিকে এবং নিচের দিকে থাকে অধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর অবস্থান।
টিআইয়ের সূচক তৈরি করার পদ্ধতি বা এর বিশ্বাসযোগ্যতা আজকের আলোচনার মুখ্য বিষয় নয়। এ বিষয়ে আলোকপাত করার মতো অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন। আমি হরিপদ কেরানি পুরো ব্যাপারটাকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে চাই। তাহলে একটু ঝেড়ে কাশি, খোলাসা করে বলি,
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০২০ অনুযায়ী ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬। নিচের দিক থেকে আমাদের অবস্থান ১২তম। অর্থাৎ পৃথিবী নামক এই গ্রহে আমরা অন্যতম একটি দুর্নীতিপরায়ণ দেশ! দুঃখজনক হলো, দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের নিচে আছে কেবল আফগানিস্তান। এমনকি পাকিস্তানও আমাদের ওপরে, তাদের অবস্থান ১২৪! ভারত আছে ৮৬ নম্বরে, শ্রীলঙ্কা ৯৪ আর নেপাল আছে ১১৭তে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে ভুটান। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় হিমালয়কন্যা ভুটান অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় যোজন যোজন এগিয়ে। তাদের অবস্থান ২৪।
সুইজারল্যান্ড বিশ্বের অন্যতম কম দুর্নীতিগ্রস্ত একটি দেশ। সূচকে তাদের অবস্থান ৩। মানে ওরা সাধু। তো সমস্যা কোথায়? ভূস্বর্গ হিসেবে খ্যাত সুইজারল্যান্ড পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অসাধু ব্যবসায়ী, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের অবৈধ উপার্জনের অর্থ ও সম্পদ জমা করার স্বর্গরাজ্য। বিভিন্ন দেশে অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থের উল্লেখযোগ্য অংশ জমা হয় সুশাসনের জন্য বিখ্যাত এই দেশের ব্যাংকগুলোতে। কারণটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। বিদেশি গ্রাহকের গোপনীয়তা রক্ষায় তারা বদ্ধপরিকর। আর এই ব্যাপারটা নিশ্চিত করে সুইস ফেডারেল ব্যাংকিং কমিশন। দেশটির আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক দু-একটি ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি ব্যতিরেকে কোনো গ্রাহকের হিসাবের তথ্য প্রকাশ করতে পারে না। কেউ এই আইন অমান্য করলে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে জেল আর ৫০ হাজার সুইস ফ্রাঙ্ক জরিমানা। এ গোপনীয়তার অধিকার দেশটির আইনব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ ও তাদের ফেডারেল সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত।
জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাধ্যবাধকতা এবং বিশ্বব্যাপী জনমতের চাপে কয়েক বছর ধরে সুইস ব্যাংকগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে আমানতকারীর তথ্য প্রকাশ করছে। তারা বর্তমানে বার্ষিক প্রতিবেদনে দেশওয়ারি বিদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ উল্লেখ করছে। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত টাকার পরিমাণ ৫ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা! স্বর্ণালংকার বা অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ এই হিসাবের বাইরে। কোনো বাংলাদেশি, নাগরিকত্ব গোপন রেখে অর্থ জমা রেখে থাকলে, ওই টাকা এ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত নয়। এ কথা বলা বোধ হয় অত্ত্যুক্তি হবে না যে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদের অধিকাংশই অবৈধ পন্থায় অর্জিত এবং পাচার করা।
বাংলাদেশ থেকে বছরে কত টাকা পাচার হয়? যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৭ হাজার ২৮৩ কোটি ডলার, টাকার অঙ্কে ৬ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। বছরে গড়ে প্রায় ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়।
সুইজারল্যান্ড ছাড়াও কানাডা, সিঙ্গাপুর, লুক্সেমবার্গের মতো দেশেও অর্থ পাচার হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। টিআইয়ের সূচক অনুযায়ী, সিঙ্গাপুর ৩, লুক্সেমবার্গ ০৯ ও কানাডার অবস্থান ১১। অর্থাৎ এ দেশগুলো একেবারেই কম দুর্নীতিগ্রস্ত এবং সুশাসনের জন্য বিখ্যাত।
ব্যাপারটা কী দাঁড়াল তাহলে? দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকার সুরক্ষা যারা দেয়, তারা সাধু! হঠকারিতা নয় কি? পশ্চিমাদের তথাকথিত ভালোমানুষির এক কদর্য দিক। আমাদের কাছে ব্যাপারটা সোজাসাপ্টা; কবিগুরুর ভাষায়:
‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে’।
*লেখক: সাজ্জাদুল হাসান, একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত।