তিউনিসিয়ায় শুরু হওয়া আরব বসন্তের ঢেউ কি ইয়েমেনে

ফাইল ছবি

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনেরও ইন্ধন জুগিয়েছিল আরব বসন্ত। ইয়েমেনে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় ছিলেন আলী আবদুল্লাহ সালেহ। গণ-আন্দোলনের মুখে ২০১১ সালের নভেম্বরে সৌদি আরবে পালিয়ে যান আবদুল্লাহ সালেহ। এর আগে তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করার পর হাদিকে অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, বেকারত্ব আর খাদ্যসংকটের মধ্যে আল কায়েদার হামলা, দক্ষিণে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও হুতিদের নতুন করে বিদ্রোহের সূচনা। মূলত সালেহ সরকারের ক্ষমতা বদলের পরপরই ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটে।

ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ কার্যত দেশটিকে একাধিক সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর মধ্যে বিভক্ত করে দেয়। হুতি বিদ্রোহীরা নিয়ন্ত্রণ নেয় দেশটির কিছু অঞ্চল, কিছু অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে হাদি সরকার ও তার সমর্থকেরা এবং আল কায়েদা ও আইএসের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় কিছু অঞ্চল।

২০১৪ সালের শুরুর দিকে হুতি বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের সাদা প্রদেশ ও এর আশপাশের এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং ২০১৫-এর প্রথম দিকে সানার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ার পর জোরালো আক্রমণের মুখে পড়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদি। এরপর হুতিরা গোটা দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা শুরু করলে টনক নড়ে সৌদি আরবের। শিয়া হুতি বিদ্রোহীদের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতা দিচ্ছে ইরান, এমন অভিযোগ করে হুতিদের দমনে সৌদি সামরিক জোট গঠন করে তারা এবং তাদের গোয়েন্দা তথ্য ও সামরিক সহায়তা দেওয়া শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স।

ইয়েমেন যুদ্ধে ৩ লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশের বয়স ৫ বছরের নিচে। সেখানে শিশুরা ভুগছে ক্ষুধা, অপুষ্টিসহ যুদ্ধসংশ্লিষ্ট নানা রোগে
ছবি: এএফপি

অবশেষে ২০১৫ সালের মার্চে সৌদি সামরিক জোট হুতিদের দমন করে হাদি সরকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য ইয়েমেনে হামলা শুরু করলে দেশটিতে মূলত দুটি প্রধান বিবদমান পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। একদিকে সৌদি আরব জোট-সমর্থিত সরকার পক্ষ, অন্যদিকে ইরান ও আরব শিয়া গোষ্ঠী-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা।
ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরব, ইরান ও হেভিওয়েট রাষ্ট্রগুলোর জড়ানোর কারণ কী?

সৌদি আরব: তাদের এ যুদ্ধে জড়ানোর প্রধান কারণ হচ্ছে ইরান ইস্যু। সৌদি আরবের অভিযোগ, ইরান হুতি বিদ্রোহীদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করছে। তাই হুতি বিদ্রোহীদের দমন না করলে সৌদি আরবের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। এ ছাড়া উপসাগরের আঞ্চলিক রাজনীতিতে ইরানের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাক, সৌদি আরব তা কখনোই চাইবে না।

যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা: প্রথমত, তারা যেকোনো উপায়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান, রাশিয়া বা চীনের প্রভাব রুখতে চায়। আর তেল স্বার্থের ব্যাপার তো রয়েছেই। লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরের মাঝখানে দেশটির অবস্থান। এ নৌপথ দিয়েই বিশ্বের সিংহভাগ তেলবাহী জাহাজ চলাচল করে। এ অংশ নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়লে তেল পরিবহনও হুমকির মুখে পড়বে

ইরান: আরব বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের শিয়া আন্দোলনকে ইন্ধন জোগানোই ইরানের কাজ। এ ছাড়া কৌশলগত কারণে এ অঞ্চল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাব এল মান্দেব এর ওপর অবস্থান করায় এ অঞ্চলের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরের বাণিজ্যে নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার সুযোগ থাকলে ইরান তা হাতছাড়া করতে চাইবে কেন?

ইয়েমেনের এ সংকট মূলত সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে আঞ্চলিক ক্ষমতার লড়াই। নিজেদের স্বার্থ ও প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে ইয়েমেনের মাটিতে প্রক্সি-যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে সৌদি আরব ও ইরান।

*লেখক: মোহাম্মদ ডিকে দুর্জয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়