তামাক খাত থেকে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি সম্ভব
তামাকজাত দ্রব্য বলতে আমরা বিড়ি, সিগারেট, চুরুট, গুল, জর্দা ইত্যাদি বুঝে থাকি। চুইং টোব্যাকো বা চিবিয়ে খাওয়ার তামাকজাত দ্রব্যের মধ্যে গুল, জর্দা ইত্যাদি বহুল ব্যবহৃত। তবে তামাকের বাজারে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও প্রচলিত হলো সিগারেট। বাজারে মূলত চার স্তরের সিগারেট বিদ্যমান—প্রিমিয়াম, উচ্চস্তর, মাঝারি ও নিম্নস্তর।
একটি সমীক্ষা মোতাবেক, দেশে দুই কোটির বেশি সিগারেটের ভোক্তা রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সব স্তরের সিগারেটের মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করে। দেশের মোট অভ্যন্তরীণ রাজস্বের ১০ শতাংশের বেশি আসে তামাক খাত থেকে। তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার কমানো এবং একই সঙ্গে রাজস্ব আয় বাড়াতে প্রতিবছর সিগারেটের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়ে থাকে।
তামাক খাত–সংশ্লিষ্টদের মতে, জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হওয়া সত্ত্বেও সরকার এই শিল্পের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে পারছে না। এর অন্যতম কারণ সরকারের মোট রাজস্ব আয়ের বেশির ভাগ এই খাত থেকে আসে। বাজেট প্রণয়নের সময় বরাবরই দেখা যায়, তামাকশিল্পের ওপর আলাদা লক্ষ্যমাত্রার চাপ প্রয়োগ করা হয়।
সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য এনবিআর কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সুচিন্তিত রাজস্বনীতি গ্রহণ করে যাচ্ছে। আর এই রাজস্বনীতির কারণে কোভিড–পরবর্তী সময়ে সিগারেট বিক্রি হ্রাস পেলেও তা সরকারের রাজস্ব আয় ও বাজারের স্থিতিশীলতার ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। এনবিআর পরবর্তী বাজেট সামনে রেখে ইতিমধ্যে সিগারেট উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছে। কর আদায়কারী কমিশনারদের সঙ্গেও এই বিষয়ে এনবিআর আলোচনা করছে। এই খাত থেকে যেন রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়, পরবর্তী বাজেটে সিগারেটের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে এমন কৌশলের কথা ভাবা হচ্ছে।
এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্লেষকদের মতে, আরও সতর্কতার সঙ্গে সিগারেটের মূল্য নির্ধারণ করা হলে তামাক খাত থেকে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি সম্ভব। মাঝারি স্তরের সিগারেটের দাম বাড়লে মাঝারি স্তরের ভোক্তারা নিম্নস্তরের সিগারেটে ও নিম্নস্তরের সিগারেটের ভোক্তারা বিড়ি অথবা ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া সিগারেট বা সরকারের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি হওয়া সিগারেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
মাঝারি ও নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম বেড়ে গেলে ভোক্তাদের মধ্যে আরও কম দামের পণ্য ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া অবৈধভাবে উৎপাদিত সিগারেটের ব্যবসা বেড়ে যায়। কৌশলে কর ফাঁকি দিয়ে কিছু উৎপাদক এনবিআরের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম দামে সিগারেট বিক্রি করে। ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারায়, সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ে।
সিগারেটের প্যাকেটে জাল ট্যাক্স-স্ট্যাম্প ও ব্যান্ডরোল ব্যবহার সম্পূর্ণ অবৈধ। কিছু উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডের কারণে এই খাত থেকে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আয় করতে এনবিআর–কে হিমশিম খেতে হয়। চলতি অর্থবছরের বাজেটে নিম্নস্তরের সিগারেটের ১০ শলাকার দাম ৩৯ টাকা বা তদূর্ধ্ব, যার মধ্যে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সরকারকে সম্পূরক শুল্ক হিসেবে ২৮ টাকা (৫৭ শতাংশ) ও মাঝারি স্তরের ১০ শলাকার দাম ৬৩ টাকা বা তদূর্ধ্ব, যার মধ্যে প্রায় ৫১ টাকা (প্রায় ৮১ শতাংশ) কর প্রদান করে। কিন্তু ব্যান্ডরোল বা ট্যাক্স-স্ট্যাম্প নকল করে সিগারেট বাজারজাত করলে সম্পূর্ণ টাকাই ব্যবসায়ীর পকেটে যায়।
এনবিআর গত বছর স্ট্যাম্প বা ব্যান্ডরোল ব্যবহার পদ্ধতি বিধিমালা সংশোধন করেছে। যার মাধ্যমে স্ট্যাম্প ও ব্যান্ডরোলের হিসাব সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মূল্যস্তরভেদে স্ট্যাম্প বা ব্যান্ডরোলের ব্যবহার ও ভ্যাট বা সম্পূরক শুল্ক আদায়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নিয়মিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মজুতের তথ্য নিতে কমিশনারদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে পূর্ববর্তী মাসের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি বা হ্রাসের তথ্য এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ে জমা দিতে বলা হয়েছে।
এনবিআরের উদ্যোগের অংশ হিসেবে সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় জাল স্ট্যাম্প বা ব্যান্ডরোল জব্দ ও জরিমানা এবং অনুমোদনহীন বেশ কিছু কারখানা বন্ধ করা হয়েছে। তবু এই অপরাধ সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। কঠোর নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া সিগারেটের প্রসার ঠেকানো সম্ভব বলে রাজস্ব প্রদানকারী বৈধ প্রতিষ্ঠানগুলো মনে করে।
রাজস্ব ফাঁকি বন্ধে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা যেতে পারে। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের বিস্তারিত তথ্য এনবিআরের কাছে থাকতে হবে, যা রাজস্ব ফাঁকি বন্ধের উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক। এ ছাড়া নকল স্ট্যাম্প বা ব্যান্ডরোলের ব্যবহার বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় এনবিআর–কে আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।
লেখক: মিফতাহ আরিফ