তাজির মা’র দুঃখ প্রকল্পের গল্প

তাজির মা’র প্রকল্পের খাদ্যসহায়তা কার্যক্রম
ছবি: সংগৃহীত

খাদ্যসহায়তা কাদের দরকার, তা জানতে আমাদের ফিল্ড ভিজিট থাকে পতিতাদের পল্লিতে, হিজড়াদের এলাকায়, রাস্তার ভাসমান বয়স্ক ভিক্ষুকদের সঙ্গে। পতিতাদের ওখানে যাঁরা বুড়িয়ে গেছেন, তাঁরা কাজ করতে পারেন না, তাঁদের কথা আর কাহিনি শুনে দুদিন আমার চোখে পানি এসেছে। এত অসহায় লাগে...কিন্তু পকেটে এক টাকাও নেই ওদের জন্য।

রেললাইনের পাশে বস্তিটা সরকার ভেঙে দিয়েছে। সবাই সরেনি অবশ্য। যাঁরা সরেননি, তাঁদের আসলে সরার জায়গা নেই। ভাঙা ঘরে বৃষ্টি ঢোকে। এই একবিংশ শতকেও মধ্যম আয়ের দেশের রাহেলা, আনোয়ারা, পারুলের মতো ৮০ বছরের বৃদ্ধারা পচা ভাত শুকিয়ে চাল করে আবার ভাত রান্না করে খান। কোভিডের মধ্যে ভিক্ষাও জোটে না। একশনএইড তাঁদের ত্রাণ দিচ্ছে। কিন্তু এই ত্রাণে বড়জোর এক মাস চলবে তাঁদের। এরপর কী হবে? আমাদের তো সামর্থ্য নেই তাঁদের সমস্যার স্থায়ী একটা সুরাহা করার। তবু চেয়েছি যতটা করা যায় আমাদের পক্ষে, আমরা করব। আমরা মরিয়া হয়ে নিজেদের এক মাসের বেতন দান করেছি এই অসহায় ব্যক্তিদের জন্য এক মাসের চাল কিনতে। কিন্তু আমাদের বেতন অনেক কম। এতে কিছুই হয় না। আমরা মা–বাবার পকেট থেকেও টাকা নিলাম, তাতেও হয় না, রাস্তায় টাকা তোলা শুরু হলো আজিমপুর, দনিয়াতে। ছাত্ররাও কেউ কেউ দিল, তাতে কিছু টাকা পাওয়া গেল।

কিন্তু বাজারে গিয়ে শুনি চালের কেজি ৫৫ টাকা। যে কয় টাকা আছে, তাতে এ দরে চাল কিনলে কিছুই থাকে না। আমরা হতাশ হয়ে গেলাম। রাইস মিলগুলোতে ফোন দেওয়া হলো, দেখলাম পরিবহন খরচে পোষায় না। জুরাইন খাদ্যগুদামে গিয়ে জানলাম, ওরা দিতে পারবে না। ওরা কেবল চালের ডিলারদের চাল দেয়। ঢাকা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে গেলাম। তিনি মেইলে জানালেন যে ঢাকা জেলায় ওএমএস সেবা বন্ধ আছে। আমরা যেন প্রধান খাদ্য নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। গেলাম খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সরবরাহ, বিতরণ, বণ্টন বিভাগে। পরিচালক সাহেবও অপারগ। এ রকম কিছু নাকি নীতিমালায় নেই। ফলাফল শূন্য।

দারিদ্র্যের স্থায়ী বিমোচনে কাজ করতে চান যুবকেরা
ছবি: সংগৃহীত

তখন আমরা এত ক্লান্ত যে একে অন্যের চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝে গেছি যে প্রয়োজনে মন্ত্রী পর্যায়ে যাব কিন্তু হারব না। দুপুরে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দপ্তরে গেলাম। তিনিও নাকচ করে দিলেন।

আমরা অবস্থান নিলাম তার রুমের বাইরেই। যে পর্যন্ত তিনি আমাদের বৃদ্ধাদের সরকারি মূল্যে চাল দেবেন না, আমরাও অবস্থান থেকে সরব না। তিনি আমাদের তলব করলেন। আমাদের সব কথা শুনে প্রধান খাদ্য নিয়ন্ত্রক সাহেবকে ফোন দিয়ে মৌখিক নির্দেশ দিলেন যেন আমরা সরকারি মূল্যে চাল পাই। আমরা ধন্যবাদ দিয়ে বেরোবার সময় আবার ডাকলেন। বললেন, ‘এবার বোকামি করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে এসে জ্বালাতন করেছ। জ্বালাতন কর, বাধা নেই। তবে সামনেরবার ত্রাণ মন্ত্রণালয়েও যেয়ো। ওখানে টাকা দিয়ে কিনতে হবে না। এভাবে জ্বালাতন করলে এমনিই চাল দিয়ে দেবে।’ আমরা বোকা হাসি দিলাম।

মহাপরিচালক সরোয়ার আলমের মৌখিক নির্দেশের বিষয়টি আমরা সবাইকেই জানাই। তার এই নির্দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক–শিক্ষিকা, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আশাতীত আর্থিক সাহায্য পাওয়া যায়। একদিকে আর্থিক সাহায্য আর অন্যদিকে সরকারের কাছ থেকে অর্ধেক মূল্যে চাল পেয়ে ত্রাণকাজ নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়। গেন্ডারিয়া ও আজিমপুর এলাকায় ত্রাণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন যুবারা।

গত ২০ সেপ্টেম্বর গেন্ডারিয়া এলাকায় এই ত্রাণ কর্মসূচির উদ্বোধন অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নারী মৈত্রীর প্রকল্প ব্যবস্থাপক তাসলিমা হুদা স্বপ্না, প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হন ৪৫, ৪৬, ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর সাথী আক্তার।

এদিকে ২১ সেপ্টেম্বরে আজিমপুরে দ্বিতীয় পর্যায়ের ত্রাণ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক রাশিদা বেগম, প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আলহাজ হাসিবুর রহমান মানিক।

সরকারের বিভিন্ন সংস্থা থেকে সহায়তাও পেয়েছে তাজির মা’র প্রকল্প
ছবি: সংগৃহীত

কাউন্সিলর সাথী আক্তার বলেন, যুবদের এই কাজে আমিও অনুপ্রেরণা পাই। সরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে যেসব ত্রাণ আমরা দিয়েছি, তা প্রয়োজন পুরোপুরি মেটাতে পারেনি। আর যারা কখনোই ত্রাণের আওতায় আসে না, যারা জানেই না কোথায় ত্রাণ দেয়, তাদের বাছাই করে ত্রাণ দেওয়ার বিষয়টিই যুবাদের সবচেয়ে বড় সফলতা।
কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক বলেন, যুবকদের এই কাজ সত্যিই প্রশংসার বিষয়। ত্রাণ অনেকেই দেয়, কিন্তু এভাবে নিজেদের বেতন দান করে, সরকার থেকে দেনদরবার করে কম মূল্যে চাল কিনে বিনা মূল্যে দেওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। তাদের এ ধরনের সব কাজে স্থানীয় সরকার পাশে আছে।

গত ২৬ সেপ্টেম্বর রোববার, আজিমপুরে তৃতীয় পর্যায়ের ত্রাণ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন শেখ শাকিল আহমেদ। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ২৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মকবুল হোসেন। যুবকদের এই কার্যক্রমের ইতিবৃত্ত মকবুল হোসেনকে আপ্লুত করে। অশ্রুভেজা চোখে তিনি সর্বদা এই তরুণদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন এবং সমাজকর্মে কাজ করে যাওয়ার জন্য যুবাদের প্রেরণা দেন।

যুব পরিষদ বাংলাদেশের সভাপতি মুস্তাফিজুর রহমান হিমেল এই কাজকে সফল করার জন্য খাদ্য অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার ও নারী মৈত্রীকে ধন্যবাদ দেন। তিনি জানান, আমরা যা করছি তা সাময়িকভাবে মানসিক যন্ত্রণা থেকে আমাদের মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু খাদ্যসহায়তার মাধ্যমে মূল সমস্যা নির্মূল করা যাবে না। আমরা যুবকেরা মিলে সামনে দারিদ্র্যের স্থায়ী বিমোচনে কাজ করতে চাই। ইতিমধ্যে আমরা ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থানবিষয়ক অর্থনৈতিক গবেষণার কাজ শুরু করেছি। গবেষণা শেষে আমরা মাঠে নামব। আমাদের পুরো ঘটনা শোনার পর কয়েক দিন আগেই যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আখতারুজ্জামান আমাদের তাঁর অধিদপ্তরের সঙ্গে যুব কর্মসংস্থানবিষয়ক গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

খাদ্যসহায়তার চাল
ছবি: সংগৃহীত

তাজির মা’র প্রকল্পের এভাবে খাদ্যসহায়তার কাজ দিয়ে যাত্রা শুরু হলো, এর শেষটা হবে দারিদ্র্যের বিলুপ্তি দিয়ে। আমাদের কাজ আর স্বপ্নের পরিধি শুনে আকাশকুসুম মনে হতে পারে কিন্তু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে আমরা আমাদের স্বপ্নের সমান বড়। আর স্বপ্ন বাস্তব হবেই। এটি বাস্তব করতে যা করা প্রয়োজন আমরা তা করব।