তরুণ প্রজন্ম ও ভাষা বিকৃতি মহামারি

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
ছবি: প্রথম আলো

তরুণ প্রজন্ম একটি দেশের ভবিষ্যৎ। একটি সমাজ বা রাষ্ট্র এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রধান হাত রয়েছে তরুণদের। তরুণদের শক্ত কাঁধে ভর করে সমাজ বা রাষ্ট্র ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। প্রজন্মকে ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত করার পেছনে তরুণদের রয়েছে এক বিশাল অবদান। একটি ছুরি দিয়ে যেমন ভালো এবং খারাপ দুই ধরনের কাজ করা যায়, তেমনি তরুণদের এই শক্ত কাঁধে ভর করে ভালো এবং খারাপ দুই ধরনের ভবিষ্যৎ দেখাই সম্ভব। তাই তরুণদের হতে হবে সঠিক এবং সত্যের পথে সোচ্চার। হতে হবে সত্যের পথে বলীয়ান। বাংলা ভাষা কোনো চাট্টিখানি কথা নয়। বাংলা আমার মায়ের ভাষা, এই মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া মোটেও সহজ ছিল না। রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে সালাম, বরকত, রফিক, শফিকের মতো তরুণদের রক্তে। আবির্ভাব হয়েছে রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারির। এত ত্যাগ-তিতিক্ষা পেরিয়ে আমরা পেয়েছি বাংলা ভাষা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

আমরা বাঙালি, বাংলা ভাষাতে আমাদের পরিচয়। এ বাংলা ভাষাকে ভুলে গেলে চলবে না। বাংলা ভাষাকে মনের মধ্যে, চিন্তাচেতনার মধ্যে আঁকড়ে ধরতে হবে এবং তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদের মতো করে হস্তান্তর করতে হবে।

তরুণ প্রজন্মই হচ্ছে ভবিষ্যতের ধারক ও বাহক। তাই তরুণদের প্রতিটি রক্তবিন্দুতে বাংলা ভাষার চেতনা থাকতে হবে, বাংলা ভাষার মর্মকে ধারণ করতে হবে। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের অনেকেই বাংলা ভাষার সঠিক ইতিহাস জানে না, সঠিকভাবে বাংলা ভাষার বুলি উচ্চারণ করতে পারে না। তারা পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে বাঙালি সংস্কৃতিকে ভুলে যাচ্ছে। বাংলার সংস্কৃতি ও পশ্চিমা বিশ্বের সংস্কৃতি যেন মিলিয়ে ফেলছে। আর বাংলা হারিয়ে ফেলছে তার নিজস্বতা। বর্তমানে বাংলা ভাষার সঠিক উচ্চারণ দেখা বড় দায়। বর্তমান প্রজন্ম নিজেদের পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে অনেক বেশি পরিবর্তন করে ফেলছে। যার কারণে বাংলা ভাষার নিজস্ব ধাতু ও মূলকে পরিবর্তন করে পশ্চিমা বিশ্বের ধাঁচে বাংলাকে উচ্চারণ করেছে। এর কারণে শুধু আমাদের বাংলা ভাষাই বিকৃত হচ্ছে না, বরং হুমকির মুখে পড়ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও।

বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের চিন্তা-চেতনা শুধু ডিজিটাল যুগ এবং ডিজিটাল ডিভাইসে সীমাবদ্ধ। ডিজিটাল যুগ ছাড়া যেমন চলবে না, তেমনি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে নিজের নাড়ির সম্পর্ক ভুলে গেলেও চলবে না। মনে রাখতে হবে, আমরা বীর বাঙালি জাতি। আমাদের রয়েছে নিজস্ব পরিচয়, নিজস্ব চেতনা। এ চেতনা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পর্যন্ত আমাদেরই পৌঁছে দিতে হবে।

বাংলা সংস্কৃতি বিশাল এক সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতিকে এক দিনে রপ্ত করা যাবে না। একে রপ্ত করতে প্রয়োজন অনেক বেশি চর্চা। বাংলা সংস্কৃতির সঠিক চর্চাই পারে বাংলা ভাষা, বাংলার চেতনাকে রক্ষা করতে। এ সমস্যা সমাধানে তরুণের বলিষ্ঠ কাঁধের বিকল্প কিছুই নয়।

তরুণসমাজকে সঠিকভাবে বাংলার সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে। বাংলা ভাষা, বাংলা ব্যাকরণ, বাংলা ভাষার ইতিহাস—সবকিছু রপ্ত করতে হবে। শুধু স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার ইতিহাস নামের বিষয়টি থাকলেই চলবে না, সাধারণের জীবনে বাংলা ভাষার চর্চা রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিনে বন্ধুদের আড্ডায় কোনো ভিনদেশি গান বাজিয়ে আনন্দ করলে চলবে না, বরং সেখানে বাঙালি লোকসংগীত, জারি-সারি, কলের গানের চর্চা করতে হবে। বাংলা ভাষার বিকৃতিকে ঠেকাতে হলে পদে পদে বাংলা ভাষাকে নিয়ে লড়াই করতে হবে। তবেই বাংলা ভাষা বিকৃতির এ অপচেষ্টাকে হারিয়ে দেওয়া সম্ভব। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর ‘১৮ বছর বয়স’ কবিতায় খুব সুন্দরভাবে ১৮ বছর বয়সী তরুণদের দুর্বার তেজের কথা ব্যক্ত করেছেন। বাংলা ভাষা চর্চায় আজ সেই চেতনার অভাব রয়েছে। তাই তরুণদের উজ্জীবিত হতে হবে নতুন চেতনায়, নতুন উত্তেজনায়। বাংলা ভাষার প্রতি সঠিক চেতনাই পারে বাংলা ভাষার বিকৃতির এ মহামারি রোধ করতে।


লেখক: সানোয়ার হোসেন, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া