তথ্য অধিকার আইন ও তথ্য কমিশনের উপস্থিতি
সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে হেনস্তা ও কারাগারে প্রেরণের কারণে (জামিনে মুক্তি পেয়েছেন রোজিনা ইমলাম) তথ্য অধিকার আইনের বিষয়টি জনসমাজে অনেক বেশি আলোচিত হচ্ছে। অপরাধীদের তথ্য সংগ্রহের জন্য পুলিশ প্রশাসনের যেমন সোর্স থাকে, তেমনটি সাংবাদিকেরও। তবে দুটির মধ্যে গুণগত পার্থক্য রয়েছে। পুলিশের প্রচলিত সোর্স হিসেবে সাধারণত বিভিন্ন মাপের অপরাধীদের ব্যবহার করা হয়। সময় সময় সেই সোর্সদের আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থাও থাকে। অন্যদিকে নবীন সংবাদকর্মীরা রাজনীতি, অর্থনীতি, অপরাধ, খেলাধুলা—এরূপ বিভিন্ন বিটে কাজ করতে করতে কালের পরিক্রমায় প্রবীণ সাংবাদিক হন। তাঁদের একটা সোশ্যাল নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। এই নেটওয়ার্কটাই তাঁদের তথ্য সংগ্রহের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত ‘তথ্য অধিকার আইন-২০০৯’–এর কার্যকর ভূমিকা রাখার ব্যাপক সুযোগ ছিল প্রায় এক যুগ ধরে। কিন্তু সেটা পুরোপুরি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। সংযুক্ত লেখচিত্রটিতে দেখা যায়, তথ্য কমিশনের শুনানির জন্য গৃহীত অভিযোগগুলোর মধ্যে সাংবাদিক পেশার মাত্র ২১ শতাংশ! অথচ তথ্য অধিকার আইনে প্রাপ্ত তথ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহারকারী ও অভিযোগকারী হওয়ার কথা ছিল সাংবাদিকতার পেশার মানুষদের।
ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে অ্যানাকোন্ডা বের হওয়ার জোগাড়! পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা জানান, প্রায় ছয় বছর তিনি একটি বিভাগের তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তথ্য প্রদান বাধ্যতামূলক, এমন অনেক তথ্য আপিল কর্তৃপক্ষ দিতে প্রায়ই আগ্রহী বোধ করতেন না। আপিল কর্তৃপক্ষ বলতে এখানে বিভাগীয় প্রধানকে বোঝানো হয়েছে।
যেহেতু আইনে তথ্য দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে; সে ক্ষেত্রে আংশিক, অসম্পূর্ণ অথবা কর্তিত তথ্য দিতে ডেস্ক কর্মকর্তাকে উৎসাহিত করা হতো। শুধু তা–ই নয়, চাহিত তথ্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেওয়ার সুযোগ থাকলেও সেখানে তথ্য অধিকার আইনের ৯ (১) ধারায় উল্লিখিত অনধিক ২০ কার্য দিবসের মধ্যে অর্থাৎ সম্ভব হলে শেষ কার্য দিবসে তথ্য সরবরাহ করার রেওয়াজ প্রচলিত ছিল, সেই বিভাগটিতে। মন্ত্রণালয়/বিভাগ/অধিদপ্তরের প্রধানেরাই যদি এমনটা করেন, তাহলে কমপক্ষে আরও ৫০ বছর তথ্য কমিশনকে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাকতে হবে। তথ্য কমিশনের প্রতিবেদনেও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বক্তব্যের সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘বার্ষিক প্রতিবেদন-২০১৮’ পর্যালোচনায় দেখা যায়, তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠানটি চারটি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেছে। তন্মধ্যে তৃতীয়টি হলো, ‘কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্বতঃপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি’। কমিশনকে ধন্যবাদ যে তারা বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছে। শুধু কমিশন নয়, তথ্য যে অধিকার, সেটা আপিল কর্তৃপক্ষকেও বুঝতে হবে, মানতে হবে।
সুখের বিষয় এই যে আমাদের প্রায় সব কটি মন্ত্রণালয়-বিভাগ-অধিদপ্তরেই দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা, বিকল্প কর্মকর্তা ও আপিল কর্তৃপক্ষ রয়েছেন। এ ছাড়া বেসরকারি সংস্থাতেও (এনজিও) তথ্য প্রদানের জন্য নিয়োজিত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রয়েছেন। ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি খাতে ৩৪ হাজার ৩৯৩ জন এবং বেসরকারি খাতে ৬ হাজার ৯০০ জন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই বিশাল জনবল আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা কতখানি পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছে? আমাদের প্রধান পত্রিকাগুলোতে যেসব দুর্নীতির খবর প্রকাশ পায়, তার কত ভাগ তথ্য অধিকার আইনের আলোকে চাহিত তথ্য থেকে প্রস্তুত করা? এ প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করলে দেখা যাবে, সেটা হয়তো পাঁচ ভাগের নিচে। এটা যেদিন অন্তত আশি ভাগে উন্নীত হবে, সেদিনই তথ্য কমিশনের উপস্থিতি টের পাওয়া যাবে। নচেত ‘করব না আর তথ্য গোপন/ স্বচ্ছ সমাজ করব গঠন’, ‘তথ্য চাইলে জনগণ/ দিতে বাধ্য প্রশাসন’, ‘সবাই মিলে তথ্য দিলে/ আলোকিত সমাজ মিলে’, ‘তথ্য পেলে জনগণ/ নিশ্চিত হবে সুশাসন’—তথ্য কমিশনের এ ধরনের স্লোগানগুলো শুধু গালভরা বুলি হিসেবেই পরিগণিত হবে এবং প্রতিবেদন-ব্যানার-ফেস্টুনের মধ্যেই সেগুলো সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। কমিশন কর্তৃক গৃহীত তথ্য অধিকারবিষয়ক পুরস্কার নীতিমালা-২০১৮–এর মতো চমৎকার সব উদ্যোগ মাঠে মারা যাবে। বিপুল জনসংখ্যার এ দেশে ২০০৯–২০১৮ সাল পর্যন্ত তথ্য কমিশনে দায়ের করা মোট অভিযোগের পরিমাণ মাত্র ২ হাজার ৯৪৪টি। এর দুটি উত্তর হতে পারে। একটি হলো চাহিত তথ্য সহজেই পাওয়া যাচ্ছে। সেটার যেহেতু কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণক নেই, সেহেতু ভিন্ন উত্তরটিই আমরা বিশ্বাস করতে বাধ্য হব অর্থাৎ তথ্যপ্রাপ্তির আইনি প্রচেষ্টায় জনগণ নিরুৎসাহিত হচ্ছে। এতে তথ্যের মূল্য বাবদ সরকার বিপুল রাজস্ব থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ তথ্য অধিকার আইন প্রতিষ্ঠায় সাংবাদিকদের অবদান নিয়ে একটি যুগান্তকারী ঘটনার উল্লেখ করেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তিনি লিখেছেন, ‘ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিষয়ে মার্কিন সরকারের প্রতিরক্ষা দপ্তর একটি সমীক্ষা করে ১৯৬৭ সালে। সেই সমীক্ষা যাঁরা করেন, তাঁদের একজন ড্যানিয়েল এলসবার্গ। এই গোপন দলিলগুলো নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিকের হাতে তুলে দেন ১৯৭১ সালে কেননা তিনি সরকারি ভাষ্যের সঙ্গে একমত ছিলেন না। তাঁর বক্তব্য ছিল এগুলো মার্কিন নাগরিক, যাদের অর্থে ভিয়েতনামে যুদ্ধ চালানো হচ্ছে, তাঁদের জানার অধিকার আছে। তিনি মনে করেছেন যে সরকার মিথ্যাচার করছে। একই সময় ওয়াশিংটন পোস্টের হাতেও এই দলিলগুলো পৌঁছায়। দুই পত্রিকাই এগুলো ছাপার উদ্যোগ নেয়। নিউইয়র্ক টাইমস ১৩ জুন থেকে ধারাবাহিকভাবে এই বিষয়ে প্রতিবেদন এবং দলিল ছাপতে শুরু করার পরে তিন দিনের মাথায় আইন মন্ত্রণালয় আদালতের কাছ থেকে সাময়িক রেস্ট্রেইনিং অর্ডার লাভ করে। এর আগে হোয়াইট হাউস এগুলো না ছাপতে অনুরোধ করেছিল পরে হুমকি দিয়েছিল যে তাঁদের রিপোর্টারদের হোয়াইট হাউসে প্রবেশাধিকার থাকবে না। সরকারের বক্তব্য ছিল, এগুলো প্রকাশিত হলে ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ বিঘ্নিত হবে। নিউইয়র্ক টাইমসের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে উপস্থিত হয়। সেই সময়ে নিউইয়র্ক টাইমসের সঙ্গে যোগ দেয় ওয়াশিংটন পোস্ট; দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী সংবাদপত্র একত্রে সরকারের বিরুদ্ধে লড়েছিল এ কথা বলে যে নাগরিকের জানার অধিকার রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট ৬-৩ ভোটে রায় দিয়েছিলেন যে সরকার এটা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে যে কেন এসব দলিল প্রকাশের ফলে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। এর পরে বোস্টন গ্লোব এবং অন্যান্য কাগজেও এসব গোপন দলিল প্রকাশিত হয়।…’ এটাই হলো সাংবাদিকতার সৌন্দর্য, সাংবাদিকদের ভূমিকা। সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে মিডিয়া হাউসগুলো একজোট হয়ে এগিয়ে এলে তখন অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাই রোধ করা সম্ভব হয়। শুধু সংবাদকর্মীই নন, গবেষকসহ সংবাদ সংগ্রহের প্রয়োজন পড়ে আমাদের সবার। যেকোনো নীতিমালা ও কৌশল প্রণয়নের প্রণয়নের পূর্বশর্ত হলো যথাযথ তথ্যের জোগান। প্রয়োজনীয় তথ্য না পেলে গবেষণাকাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় এবং সুষ্ঠুভাবে গবেষণা কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। যার অবধারিত প্রভাব হলো ত্রুটিপূর্ণ জাতীয় নীতিমালা ও কৌশল প্রণয়ন। যে কারণে প্রত্যেক আপিল কর্তৃপক্ষেরই উচিত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তথ্য অধিকার–সংবলিত সব তথ্য নিয়মিত ভিত্তিতে প্রকাশ করা। তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে যেখানে তাদের পক্ষে তথ্য অধিকার আইনে একধরনের ইনডেমনিটিরও ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে তাদের এতে ভয় কিসের
*লেখক: হোসাইন মোহাম্মদ জাকি, গবেষক