তখন ছোট ছিলাম

১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধারাফাইল ছবি

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কথা। তখন আমাদের গ্রামটিও ছিল নিরবধি সুনসান। ঝোপঝাড়, জঙ্গল, গাছে গাছে মিলন আর লোকবসতিও ছিল অনেক কম। সেকালে গাঁওগেরামে বিদ্যুৎ না থাকায় সন্ধ্যা হলেই গভীর রাত মনে হতো সেই দিনে টাকার মূল্যে নুন, মরিচ, চাল, ডালের দাম কম হলেও অর্থের জোগান ছিল নিদারুণ কষ্টের। যুদ্ধ যখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে লাগাম টানে, তখন মা-চাচিরাও রাত্রিকালে পেটভরে খেতে চাইলেও দিতেন না। কারণ, এই দুর্দিনে প্রকৃতির ডাকে যাতে শৌচাগারে (টয়লেটে) যেতে না হয়। এর ফলে চিড়া, মুড়ি, গুড়, অন্যান্য সদাই কিনে বাড়িতে ছিলাম।

দাদারা তিন ভাই—ওয়াহেদ আলী, নেওয়াজ আলী, আ. গফুর। ছোট দাদা গ্রামের কাছে আরেক বাড়িতেই থাকতেন। বড় দাদা আর মেজ দাদা মিলেমিশে এক বাড়িতেই ভাগবণ্টন করে থাকতেন। সেকালে তাঁরা মুলিবাঁশ, সুতাসহ নানামুখী ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। পূর্বের বসতি কালীরচর গ্রামটি নদীভাঙনের ফলে নতুন ঠিকানা হয় সোনারগাঁয়। এরপর ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেকটাই ভাটা পড়ে যায়। দাদাও নতুন ঠিকানায় অবস্থান নিয়ে, বাপ-চাচাদের ভাগবণ্টনও করে দেন। যদিও ব্যবসার হাল ছিল বাবার হাতে...যুদ্ধের আগের বছর অক্টোবর মাসে বাবাও মারা যান।

যুদ্ধ যখন জোরালো হয়, তখন মাকে দেখেছিলাম ঘরের মেঝেতে গর্ত করে সোনাদানা, দলিলপত্র, গুরুত্বপূর্ণ জিনিস রেখে ছাই দিয়ে অসুন্দর পরিবেশ করে রেখেছিলেন। প্রায়ই সন্ধ্যায় দাদার ঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের খেতে দেখতাম। মুক্তিকামী যোদ্ধারা দাদার আপ্যায়নে মুগ্ধ হয়ে পিতলের একটি হারিকেন উপহার দিয়ে যান।

পাকিস্তান বাহিনীর প্রধান জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি, আত্মসমর্পণের দলিলে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সই স্বাক্ষর হলে পথঘাট সচল ছিল বলে মাঝেমধ্যে মা আর আমি নানার বাড়ি যেতাম।

মোগরাপাড়া বাসস্ট্যান্ডের দক্ষিণের ছোট ব্রিজে পাকিস্তান বাহিনীর একটি ক্যাম্প তখনো ছিল। তাঁরা আমাদের বহন করা রিকশাচালককে উচ্চ স্বরে ‘এ ধারছে’ বলে ডাক দিতেন। চালক না শোনার ভান করে গাড়ি চালাতে থাকলে পাকিস্তান বাহিনীর এক সদস্য দৌড়ে গিয়ে রিকশাচালককে দুটি থাপ্পড় দিয়ে দু-এক মিনিট পরে, ‘ছুড় যাও’ বলে রিকশা ছেড়ে দেন। এ ছাড়া নানার বাড়ি যেতে পিরোজপুর গ্রামটি পাকিস্তান বাহিনীরা আগুন দিয়ে পোড়া দেখেছিলাম।

নিজ বাড়ির পাশের বাড়িতে খেলাধুলায় দিন কেটেছিল। সেই বাড়ির বড় ছেলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী ছিলেন। তিনি কর্মক্ষেত্রে একজনবেবি চালক হলেও সহযোগী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অপারেশনে যেতে ঐতিহাসিক গ্রান্ডট্রাঙ্ক রোডের পিঠাওয়ালি ব্রিজে হানাদার বাহিনীর বোমার আঘাতে তাঁর ডান চোখ অন্ধ হয়ে যায় (এই পিঠাওয়ালি ব্রিজের নিচে দেখে ছিলাম একটি বিস্ফোরিত কাউঠা গাড়ি)। বিষয়টি নিজ এলাকার অনেকেরই অজানা। ছোটকালেও একটু কৌতূহলী ছিলাম বলেই জেনেছিলাম কিন্তু তিনিও আজ নেই।

যুদ্ধদিনের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে এসব অস্ত্র। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি জাতির জন্মের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আক্রমণের জবাব পুলিশ দিয়েছিল এসব অস্ত্র ব্যবহার করে। গতকাল রাজধানীর রাজারবাগে পুলিশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে
ছবি: সাজিদ হোসেন

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে তৎকালীন পাকিস্তানি সরকারের নির্দেশে নিরীহ বাঙালিদের ওপর গভীর রাত্রিতে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গোলাবর্ষণ, কোথাও নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন, জীবন হরণের কথা রেডিওতে শুনেই গ্রামের নারী-পুরুষের আস্থার জায়গা খুঁজে বেড়াতেন। এমন অবস্থায় বাঙালিদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষা না করেই অনেকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। অনেক বাঙালি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পাওয়ার পরই বাঙালি বীর জনতা পশ্চিম পাকিস্তানি জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়। ১৯৭২ সালে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছিল। তখন ভট্টপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণিতে পড়তাম। এ সংকটকালে ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়মুখী ও উৎসাহিত করতে ছাতুর দলা (লাড্ডু), বিলাতি দুধ, বিস্কুট খেয়েছিলাম। তখন বিদ্যাপীঠের দপ্তরি ছিলেন ভবনাথপুর গ্রামের চান বাদশা মিয়া। তিনি এখনো বেঁচে আছেন।

সেকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা শাসন, বারণে ছিলেন কঠোর। একুশে ফেব্রুয়ারিতে সকালে বিদ্যালয়ের মাঠে সব শিক্ষার্থী উপস্থিতি হলে প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক–শিক্ষিকাসহ ছাত্রছাত্রীদের লম্বালম্বি সারিবদ্ধ হয়ে দেড় কিলোমিটার পথ হেঁটে (সি ও এর মাঠে) শহীদ মিনারে যেতাম ফুল দিতে। মনে পড়ে ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা অথবা ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস অথবা ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের রাত্রিকালে কারও না কারও বাড়ি থেকে ভাই, বন্ধু মিলে, না বলে, ফুলও ছিঁড়ে আনতাম। এই তিন দিবসে খেলাধুলার ছলে অভিভাবকের কাছ থেকে দু–তিন টাকা পকেটে থাকলে আমরাই ছিলাম মহারাজ।

*মোহাম্মদ মহসীন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক