ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সেই শিশুপার্ক
সরকারিভাবে নির্মিত প্রথম শিশুপার্ক ঢাকার শাহবাগে। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে ১৫ একর জমির ওপর এটি প্রতিষ্ঠিত। ১৯৮৩ সাল থেকে ঢাকা সিটি করপোরেশন পার্কটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
ডিএসসিসির যান্ত্রিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পার্কটির নাম দফায় দফায় পাল্টানো হয়েছে। প্রথমে নামকরণ করা হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান শিশুপার্ক। এরপর ঢাকা শিশুপার্ক। তারপর কেন্দ্রীয় শিশুপার্ক। অতঃপর শহীদ জিয়া শিশুপার্ক নামকরণ হয় ২০০৩ সালে। সর্বশেষ শেখ রাসেল শিশুপার্ক হিসেবে নামকরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
১২টি রাইড নিয়ে পার্কটির যাত্রা শুরু। আনন্দ ঘূর্ণি, ছোট মণিদের রেলগাড়ি, বিস্ময় চক্র, এসো গাড়ি চড়ি, চাকা পায়ে চলা, লম্ফঝম্ফ, ঝুলন্ত চেয়ার, ফুলদানি আমেজ, উড়ন্ত বিমান, উড়ন্ত নভোযান, রোমাঞ্চ চক্র—এর মতো বাহারি সব নাম দেওয়া হয় রাইডগুলোর। ১৯৯২ সালে পার্কটিতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে সৌজন্য হিসেবে দেওয়া হয় একটি জেট বিমান। শহর-বন্দর-গ্রামের শিশুদের কাছে বিনোদনের অন্যতম উৎস ছিল ঢাকার এই শিশুপার্ক। সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র শিশুদের জন্য এই পার্কটি ছিল বিশেষ কিছু। সপ্তাহে এক দিন বিনা পয়সায় উন্মুক্ত থাকত তাদের জন্য।
পার্কের শানবাঁধা বটের তলায় নানা বয়সী মানুষ গল্পে মেতে ওঠেন। বটের শিকড় ধরে ঝুলতে থাকা শিশু-কিশোর। গাছের ফাঁক দিয়ে চলা ট্রেন লাইন। পাতার ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের আলোয় সোনালি রং ধারণ করা পার্ক—সবই আজ ইতিহাস। অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে এই শিশুপার্কটি। ১৯৮০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘ছুটির ঘণ্টা’র শুটিং হয়েছিল এই পার্কে। ঈদের ছুটি ঘোষণার দিন স্কুলের বাথরুমে সবার অজান্তে তালাবদ্ধ হয়ে আটকে পড়া ১২ বছরের এক ছাত্রের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার করুণ দৃশ্যের ওপর নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি। পার্কের রাইডগুলোকে নিয়েই চিত্রায়ণ হয়েছিল ‘ছুটির ঘণ্টা’র, ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী, সাথি মোদের ফুলপরি...’ গানটি। আবিদা সুলতানার গাওয়া, মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানের লেখা ও সত্য সাহার সুর করা অনবদ্য এই গানটি পরবর্তী সময়ে এতটাই জনপ্রিয় হয় যে প্রায় ৪০ বছর পর ২০১৯ সালে উন্নয়নকাজের জন্য সাময়িকভাবে শিশুপার্কটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেও রাইড চলার সময়ে গানটি বাজাত পার্ক কর্তৃপক্ষ।
এ পার্ক নিয়ে রচিত হয়েছে কবি নির্মলেন্দু গুণের সেই অমর কবিতা—‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণটি মঞ্চের সামনে থেকে শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল কবির। ভাষণটিকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি ১৯৮০ সালে রচনা করেছিলেন এই কবিতা। যেখানে কবি উচ্চারণ করেছেন, ‘...এই শিশুপার্ক সেদিন ছিল না, এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না, এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না। তাহলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি? তাহলে কেমন ছিল শিশুপার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে, ফুলের বাগানে ঢেকে দেওয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি?’
ইংরেজ আমলের স্মৃতিও ধারণ করে আছে শাহবাগের এই শিশুপার্ক। ঢাকা শহর পরিষ্কার করার জন্য ১৮২৫ সালে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ড’স নিয়োগ করেছিলেন জেলের কয়েদিদের। রমনার জঙ্গল পরিষ্কার করার পর কাঠের রেলিং দিয়ে সেটা ঘিরে তৈরি করেছিলেন রেসকোর্স। রেসকোর্সের একেবারে উত্তর-পশ্চিমে ড’স একটি টিলা তৈরি করে তার চারদিকে লাগিয়েছিলেন ফারগাছ। আর টিলার ওপর তৈরি করেছিলেন গথিক রীতির ছোট একটি ঘর। ঢাকার লোকজন বাড়িটির নাম দিয়েছিলেন ড’স ফলি বা ড’সের ভুল। শহরের বাইরে টিলা ও ঘর তৈরির জন্যই বোধ হয় এই নামকরণ। সেই ফার আর সেই ঘর না থাকলেও শিশুপার্কের ভেতরে থাকা সেই টিলাটি আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। দেশের হাজারো মানুষের শৈশবের, কৈশোরের স্মৃতি এই পার্ক টিকে থাকুক স্বমহিমায়।
লেখক: হোসাইন মোহাম্মদ জাকি, গবেষক