ঠাকুরগাঁওয়ে সৌন্দর্যের লীলাভূমি ‘টাঙ্গন ব্যারাজ’
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতাটি স্কুলপাঠ্যে ছিল। কবি লিখেছিলেন, ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।’ কবিতার সঙ্গে শতভাগ মিলে যায় সৌন্দর্যে মুগ্ধ করা টাঙ্গন নদের সঙ্গে। টাঙ্গন বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তসীমান্ত নদ। এটি পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদ।
শীতকালে নদের পানি কমে গেলেও বর্ষাকালে থই থই পানি থাকে। প্রতিবছর ভরা মৌসুমে মৎস্য বিভাগের আওতায় টাঙ্গন নদের ওপর নির্মিত টাঙ্গন ব্যারাজের প্লাবনভূমিতে সরকারিভাবে মাছ অবমুক্ত করা হয়। এর তিন মাস পর ব্যারাজের গেট খুলে দিলে এখানে শুরু হয় পাঁচ দিনব্যাপী মাছ ধরার উৎসব। পঞ্চগড়, দিনাজপুর, নীলফামারীসহ দেশের বিভিন্ন জেলার মাছশিকারিরা এখানে এসে তাঁবু গাড়েন। কেউ কলাগাছের ভেলায় আবার কেউ নৌকা করে বিস্তীর্ণ এলাকায় মাছ শিকার করেন। প্রতিদিন এখানে হাজারো মানুষের সমাগম হয়।
পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘায় সকালের কাঁচা রোদ পড়ে চকচক করা অপরূপ সৌন্দর্য দেখা যায় টাঙ্গন ব্যারাজের ওপর থেকে। টাঙ্গন ব্যারাজ থেকে ২৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে শুরু হওয়া ৩৫ কিলোমিটার টাঙ্গন নদের খননকাজ চলমান। ইতিমধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবিত ‘টাঙ্গন ব্যারাজসহ কয়েকটি সেচ প্রকল্প পুনর্বাসন, নদীর তীর সংরক্ষণ ও সম্মিলিত পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো নির্মাণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদিত হয়েছে। প্রকল্পটির মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ২৯৬ কোটি ৩৬ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। প্রকল্পটির অনুমোদিত মেয়াদ ১ জুলাই ২০২১ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত। কাজ শেষ হলে পূর্ণতা পাবে টাঙ্গনের মুগ্ধ করা সৌন্দর্য।
টাঙ্গন নদের ওপরে ব্যারাজ
রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে এটি নির্মিত হয়। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রুহিয়া থানাধীন ১৪ নম্বর রাজাগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের চাপাতি গ্রামে অবস্থিত টাঙ্গন ব্যারাজটির ১৯৮৪-৮৫ সালে বাস্তবায়নকাজ শুরু হয়ে ১৯৯২-৯৩ সালে শেষ হয়। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল প্রকল্প এলাকার আমন মৌসুমে সেচ–সুবিধা প্রদান করা। প্রকল্প আওতাভুক্ত জমি ৬ হাজার ৭০ হেক্টর এবং সেচযোগ্য জমি ৪ হাজার ৪৫০ হেক্টর। ব্যারাজের পানি নির্গমনক্ষমতা প্রতি সেকেন্ডে ২৮৭ ঘনমিটার।
কীভাবে যাওয়া যায়
ঠাকুরগাঁও শহর থেকে উত্তরে সেনুয়া নদীর ওপর হয়ে উত্তরে ১৯ কিলোমিটার গেলেই টাঙ্গন ব্যারাজ। বেবিট্যাক্সি, অটোবাইক ও মাইক্রোবাস নিয়ে সেখানে যাওয়া যায়। নদীর পানি আটকে উজানে সৃষ্টি হয় নয়নাভিরাম দৃশ্যের। বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন অবসরের অবসাদ কাটাতে ছুটে যান টাঙ্গন ব্যারাজ এলাকায়। ভ্যানে চড়ে কিংবা পায়ে হেঁটে উপভোগ করা যায় টাঙ্গন ব্যারাজ এলাকার অপরূপ সৌন্দর্য। এখানে সুন্দর ও নিরিবিলি একটি ডাকবাংলো রয়েছে।
দুই হাজারের অধিক সদস্য নিয়ে ‘টাঙ্গন ব্যারাজ’ নামে একটি গ্রুপ তৈরি হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। সেই গ্রুপের অ্যাডমিন এনায়েত হোসেন বিপ্লব, আপেল মাহমুদ, আয়েশা সিদ্দিকা মনে করেন, স্থান, অবস্থান, সৌন্দর্য, যোগাযোগব্যবস্থা—সবকিছু মিলে সম্ভাবনার একটি পর্যটন এলাকা হতে পারে টাঙ্গন ব্যারাজ। তাঁরা বলেন, ‘ঠাকুরগাঁও–১ আসনের সাংসদ ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন ঠাকুরগাঁওয়ের অভাবনীয় উন্নয়ন করেছেন। আমরা এ বিষয়ে তাঁর সুদৃষ্টি কামনা করছি।’
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন টাঙ্গন ব্যারাজের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মতামত জানিয়ে বলেন, টাঙ্গন ব্যারাজের সামনে বর্ষা মৌসুমে বিস্তীর্ণ জলাশয় দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ তৈরি করে। ব্যারাজটির ভাটির দিকে উভয় পাশে সংরক্ষিত এলাকা পরিকল্পনামাফিক বৃক্ষরোপণসহ উন্নয়নমূলক কাজের মাধ্যমে দর্শনার্থীদের বসা ও দেখার জন্য পরিবেশের দরকার।
বর্তমানে টাঙ্গন ব্যারাজ এলাকায় দর্শনার্থীদের আসা–যাওয়ার কারণে দোকানপাট, ব্যবসা–বাণিজ্যসহ নানাবিধ উন্নয়ন হয়েছে এবং এলাকাটি একটি পিকনিক স্পট হিসেবে ব্যবহারযোগ্য। কিন্তু পিকনিক স্পট হিসিবে ব্যবহারের পরিবেশ তৈরি করা জরুরি প্রয়োজন।
*আপেল মাহমুদ, রুহিয়া, ঠাকুরগাঁও