জুমে অবসাদ

জুম অবসাদ।ছবি: ইন্টারনেট থেকে নেওয়া

৪৫ বছর বয়সী ব্রিটিশ নাগরিক জোনাথন ফোর্সটিক লন্ডনভিত্তিক একটি বৃহৎ বহুজাতিক ব্যাংকে ‘রেগুলেটরি ম্যানেজার’ হিসেবে কাজ করেন। হঠাৎ করেই মিডিয়া স্পটলাইট তাঁর দিকে। সম্প্রতি তাঁর নিজের ‘হার্ট অ্যাটাকের’ ভয়ংকর অভিজ্ঞতা নিয়ে করা একটি পোস্ট পেশাজীবীদের জনপ্রিয় যোগাযোগমাধ্যম লিঙ্কডইনে ভাইরাল হয়। পোস্টটি ইতিমধ্যে ৮০ লাখেরও বেশি দেখা হয়েছে। প্রায় আড়াই লাখ ‘লাইক’ এবং শতসহস্র ‘কমেন্ট’ করা হয়েছে পোস্টটিতে!

এক রোববার বিকেলে জোনাথন ফোর্সটিক কাজ করছিলেন; পরদিন সোমবার জরুরি একটা মিটিং ছিল। বেশ কিছু রিপোর্ট তৈরি করতে হবে তাঁকে। হঠাৎ করেই বুকে ব্যথা অনুভব করেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যে তা অসহ্য যন্ত্রণায় রূপ নেয়। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে, তবে তার আগেই তাঁর হৃদ্‌যন্ত্র আক্রান্ত হয়। গত বছর করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে জোনাথন এবং তাঁর সহকর্মীরা বাড়ি থেকেই অফিসের কাজ করছিলেন। প্রায়ই তাঁদের দিনে অন্তত ১২ ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়। অনেক সময় কাজের চাপ সামলাতে ছুটির দিনেও কাজ করতে হয় তাঁদের। একসময় শরীর বেঁকে বসে; অত্যধিক চাপ সামলাতে না পেরে হৃদ্‌যন্ত্র আক্রান্ত হয়। জোনাথনের বেলায় যা ঘটেছে, সেটাকে ‘বিচ্ছিন্ন’ এক ঘটনা হিসেবে দেখার অবকাশ নেই। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলা, দ্রুতগতিসম্পন্ন করপোরেট দুনিয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠানের অলিখিত রীতি—ভেঙে পড়ার আগপর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে কাজ—work till you collapse!
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসে যায়, বাড়িতে থেকে কর্মীরা তো সে একই কাজ করছেন, যা তাঁরা করতেন অফিসে বসে। পার্থক্যটা তাহলে কোথায়? জোনাথনের ভাষ্যমতে, বিভিন্ন কারণে দিনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় তাঁকে ব্যয় করতে হয় ‘জুম’ কলে। ‘জুম’ হচ্ছে ইন্টারনেটভিত্তিক অডিও/ভিডিও কল করার বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাপ। অফিসে থেকে কাজের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে মুখোমুখি বসে চটজলদি অনেক আলোচনা সেরে নেওয়া যায়। বাড়িতে বসে কাজ করার সময় সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বিশেষ করে একাধিক সহকর্মীর সঙ্গে একসঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ‘জুম’ কল। জুমের মতো অন্য আরও কিছু অ্যাপস, যেমন: ‘মাইক্রোসফট টিমস’, ‘গো টু মিটিং’, ‘গুগল ডুয়ো’ বেশ জনপ্রিয়। মহামারির সময় কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য এসব অ্যাপ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে শারীরিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে কর্মীদের ওপর। এমনকি জুমের সিইও এরিক ইউয়ান বলেছেন, তিনি নিজেও জুমে অনবরত মিটিং করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘জুম অবসাদ’ নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা। এটি ‘গুগল সার্চে’ অন্যতম এক অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কী এই ‘জুম অবসাদ’? এটি হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত ভিডিও-কনফারেন্সিংয়ের কারণে সৃষ্ট মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তি। জনপ্রিয় ভিডিও কনফারেন্সিং অ্যাপ জুমের নামানুসারে এই নামকরণ করা হয়েছে।

জুমের সিইও এরিক ইউয়ান।
ছবি: প্রথম আলো

স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন বিভাগের অধ্যাপক জেরেমি বাইলেনসনের গবেষণা অনুযায়ী, ‘জুম মিটিং’ অনেক বেশি ধকল বা মানসিক চাপ তৈরি করে। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় স্থির দৃষ্টিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে এ অবসাদের সৃষ্টি হয়।

ফ্রান্সের ইনসিয়াড বিজনেস স্কুলের সহযোগী অধ্যাপক জিয়ানপিয়েরো পেট্রিগ্লেইরি এবং ক্লেমসন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মারিসা শুফলার এক গবেষণায় ঘন ঘন জুম মিটিং কীভাবে মানুষকে ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত করে ফেলে, তার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের মতে, মুখোমুখি মিটিংয়ের চেয়ে ভিডিও মিটিংয়ের সময় অধিক মনোযোগী হতে হয়। ভিডিও কনফারেন্স চলাকালে দেহভঙ্গি, মৌখিক অভিব্যক্তি, কণ্ঠস্বরের ওঠানামা এবং অন্যান্য নির্বাক সংকেত সঠিকভাবে বুঝতে যথেষ্ট রকমের বেগ পেতে হয়। বলাবাহুল্য, যেকোনো কার্যকর ভাবের আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে শারীরিক ভাষা, অঙ্গভঙ্গি ও কণ্ঠস্বর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ক্ষেত্রে আরও একটি চ্যালেঞ্জ হলো ‘নীরবতা’, যা স্বাভাবিক কথোপকথনে প্রায়ই হয়ে থাকে। অনলাইন মিটিংয়ের সময় ‘নীরবতা’ আমাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে, প্রযুক্তি ঠিকভাবে কাজ করছে কি না, তা নিয়ে আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি। এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। জার্মান গবেষকেরা দেখিয়েছেন, অডিও/ভিডিও কনফারেন্সের সময় নীরবতা একধরনের নেতিবাচক মনোভাবের উদ্রেক করে; এমনকি এক/দুই সেকেন্ডের বিলম্বের কারণে অনেক সময় উত্তরদাতাকে কম বন্ধুত্বপূর্ণ মনে করা হয় বা তাঁর মনোযোগ নিয়ে সন্দেহ করা হয়। আরেকটি বিষয়, যা মানসিক চাপ তৈরি, সেটি হচ্ছে ‘ক্যামেরা’। যখন আমরা ক্যামেরার সামনে থাকি, সচেতন বা অবচেতনভাবে আরও সতর্ক হয়ে উঠি, কারণ আমরা জানি যে প্রত্যেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে এবং এই অতিরিক্ত মনোযোগ কখনো কখনো স্নায়ুর ওপরে অত্যধিক চাপ সৃষ্টি করে।

রিচার্ড ব্র্যানসন।
ছবি: ইন্টারনেট থেকে নেওয়া

অনেকেই হয়তো বলবেন, এ মহামারির সময়ে ‘জুম কল’ ছাড়া অফিস-আদালত, লেখাপড়া, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি পরিচালনা করা দুরূহ! তাহলে উপায়? সর্বপ্রথমে ভিডিও কলের সংখ্যা যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। একান্ত দরকার না হলে ক্যামেরা বন্ধ রাখতে হবে। মিটিংয়ের আগে প্রয়োজনীয় নথিপত্র, তথ্য ইত্যাদি অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সরবরাহ করলে সেগুলো অনস্ক্রিন দেখানোর প্রয়োজন পড়বে না। এতে করে দীর্ঘ সময় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না, যা ক্লান্তির অন্যতম কারণ। মিটিং যদি দীর্ঘ সময় ধরে চলে তবে, মাঝে ছোট ছোট বিরতি দিতে হবে, যাতে অংশগ্রহণকারীরা চাঙা হওয়ার সুযোগ পান। পরিবেশ আনন্দদায়ক ও অনুকূল রাখা একটি কার্যকর আলোচনার অন্যতম পূর্বশর্ত। শুরুতে অনির্ধারিত, অনানুষ্ঠানিক আলোচনা, সবার ভালো-মন্দের খোঁজখবর করা, সময়-সময় কৌতুক করা ইত্যাদি মিটিংয়ের পরিবেশ চাঙা রাখতে সাহায্য করে। অনেক সময় এমন হয় যে অংশগ্রহণকারীরা দুই পক্ষ হয়ে যান, এক পক্ষ থাকে বিচারকের ভূমিকায় আর অন্যপক্ষ আসামির কাঠগড়ায়। এ রকম পক্ষ-বিপক্ষ মানুষকে মিটিংয়ের ব্যাপারে অনাগ্রহী এবং অনুৎসাহী করে তোলে, ফলে আলোচনা কখনোই কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায় না, কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যা অন্তরায়। বরং এমন প্রচেষ্টা থাকা উচিত, যাতে অংশগ্রহণকারী সবাই আন্তরিকভাবে এবং স্বেচ্ছায় খোলামনে আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে উৎসাহী হয়।

মাত্রাতিরিক্ত ভিডিও কনফারেন্সিং বা জুম কলের ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক হতে হবে। এ বিষয়ে একটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ, স্বনামধন্য ব্যাংক ‘সিটিব্যাংকের’ প্রধান নির্বাহী জেন ফ্রেজার ইতিমধ্যে তাঁর প্রতিষ্ঠানে শুক্রবারকে ‘জুমমুক্ত দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি তাঁর সহকর্মীদের নিজের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন হতে বলেছেন; উপদেশ দিয়েছেন অফিস সময়ের বাইরে যেকোনো ধরনের ভিডিও কল বা মিটিং যেন পরিহার করা হয়। মিস ফ্রেজার এক বার্তায় বলেছেন, বাড়ি এবং অফিসের মধ্যে অস্পষ্টতা, মহামারির কারণে বাড়িতে বসে দীর্ঘক্ষণ অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকা সুস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মহামারির কারণে লাখ লাখ লোক বেকার হয়েছেন। স্বাভাবিক কারণে অনেকেই চাকরি হারানোর ভয়ে ভীত। সব সময় একটা আতঙ্ক—কোনো ভুল হয়ে গেল, যদি প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হই, তবে কি আমিও যুক্ত হব বেকারদের দীর্ঘ মিছিলে। এ রকম এক দুঃসহ পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃস্থানীয়দের হতে হবে সংবেদনশীল, সহমর্মী এবং সর্বোপরি দায়িত্বশীল। মনে রাখতে হবে, প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে হলে সুস্থ ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মী বাহিনীর বিকল্প নেই। বিখ্যাত ব্রিটিশ বহুজাতিক সংস্থা ভার্জিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা রিচার্ড ব্র্যানসন যথার্থই বলেছেন, ‘আপনার কর্মীদের যত্ন নিন, তাঁরাই আপনার ব্যবসার যত্ন নেবে।’

*লেখক: সাজ্জাদুল হাসান, একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত।