জিডিপি খাওয়া যায় না, শ্রীলঙ্কাই তার প্রমাণ

শ্রীলঙ্কায় আজ প্রমাণিত হয়েছে, জিডিপি খাওয়া যায় না। শ্রীলঙ্কার জিডিপি এখনো বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ১ হাজার ডলার বেশি। ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের দেশ শ্রীলঙ্কায় মানুষের মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ৮১৯ ডলারে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। কৌতূহলোদ্দীপক! দুঃখ ও হতাশার বিষয় হলো, নিরপরাধ সর্বসাধারণ তো রয়েছেই, শিশুরা পর্যন্ত খাদ্যসংকটে পড়েছে। একই সঙ্গে হাস্যকর যে দেশের পুরো ক্ষমতাই রাজাদের ‘পক্ষে’; প্রজাদের পক্ষে কেউ নেই! যদি প্রশ্ন করা হয়, শ্রীলঙ্কায় শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক, না রাজতান্ত্রিক? উত্তর আমরা পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিলাম। লঙ্কায় ক্ষমতাসীন পরিবারের কাছে দেশ পরিচালনা রাজতান্ত্রিক ব্যাপারের মতো। এ কারণে প্রশাসনিক জবাবদিহি ও আর্থিক শৃঙ্খলার ঘাটতি ব্যাপক। তারই প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। দেশটির শাসনকাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোয় ২০ জনের বেশি আছেন একই পরিবারের। এ ছাড়া পরিবারের ৯ সদস্য আছেন পার্লামেন্টে।

মন্ত্রিসভাতেই আছেন ‘রাজাপক্ষে’ পরিবারের পাঁচজন—প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, সেচমন্ত্রী ও যুবমন্ত্রী। এর মধ্যে প্রথম চারজন ভাই। তাঁদের মধ্যে সেজ ভাই, দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের সাংবিধানিক ক্ষমতা রাজতন্ত্রের রাজার মতো। পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি একটা দেশকে কী ভয়ানক সংকটে ফেলতে পারে, তার সমকালীন নজির লঙ্কা। অতীতে রাজত্ব করেছেন ‘সেনানায়েক’, ‘বন্দরনায়েক’রা। এখন রাজাপক্ষেদের যুগ। শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রীয় বাজেটের ৭৫ ভাগ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা রাজাপক্ষে গোত্রের ২০ থেকে ২৫ সদস্যের হাত দিয়ে খরচ হয়েছে গত কয়েক বছর। সুতরাং বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের রাজনৈতিক দায় এ বংশের ওপর বর্তায় অনেকখানি।

শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট কেবল অনুৎপাদনশীল বৃহৎ ভৌত অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য হয়েছে, এমনটি নয়। এর মূল কারণ পরিবারতন্ত্র (গোতাবায়ার ভাই ও ভাতিজারা) কর্তৃক পারিবারিক স্বার্থে ভুল রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও রাষ্ট্রের অন্যান্য স্তম্ভ, যেমন প্রশাসন, বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের মূক দর্শকের ভূমিকা পালন। শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক নৈরাজ্যের উৎসে রয়েছে রাজনীতি, গোষ্ঠীতন্ত্র, খামখেয়ালিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এখানে ক্ষমতাসীন পরিবারের কাছে দেশ পরিচালনা রাজতান্ত্রিক ব্যাপারের মতো। শ্রীলঙ্কার মানুষ এখন ডিজেল, রান্নার জ্বালানি, সবজি, খাদ্যশস্য, খাবার, ওষুধ, বিদ্যুৎ, তেল, এমনকি প্রতিদিনের খাদ্যও কিনতে পারছেন না। দৈনিক সেখানে ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না।

এমন পরিস্থিতিতে হাসপাতালগুলো জরুরি সার্জারির কাজ পর্যন্ত করতে পারছে না। আজ দেশ চালানোর মতো অর্থ শ্রীলঙ্কার হাতে নেই। ‘তেল কেনার লাইনে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে দুজনের মৃত্যু’, ‘কাগজের অভাবে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে পারল না’, ‘৭৫ বছরে এত দুর্দশা দেখেনি লঙ্কাবাসী’, ‘পেট্রলপাম্পে সৈন্য মোতায়েন’, লঙ্কার এসব শোচনীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের বিষয়। সবকিছু দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। সামগ্রিক অর্থনীতি ভেঙে পড়ে দেশটি এখন লাইনচ্যুত, ফেল স্টেট, তথা দেউলিয়াত্বের সম্মুখীন।

শ্রীলঙ্কার এ অবস্থা দেখে বুঝতে হয়, অর্থনীতি যত ভালোই থাক না কেন, ঠিকঠাক ব্যবস্থাপনা করা না গেলে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা কঠিন। গোষ্ঠীতন্ত্র একটি দেশকে কোথায় নিতে পারে, শ্রীলঙ্কা তার বাস্তব প্রমাণ। অপ্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামোয় অতিরিক্ত বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি না বাড়িয়ে অর্থনীতিতে ভঙ্গুরতা আনে। এরই নেতিবাচক ফল ভোগ করছে শ্রীলঙ্কা। একসময় সামাজিক সূচকে শ্রীলঙ্কা ছিল এ অঞ্চলের সেরা। শিক্ষার গুণাগুণেও ছিল সবচেয়ে এগিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ায় এক অনন্য দেশ হিসেবেই এত দিন শ্রীলঙ্কার পরিচিতি ছিল। শিক্ষার হার, মাথাপিছু আয়, জনকল্যাণ—সব সূচকেই তারা এগিয়ে ছিল।

অনেক দিন ধরেই দেশটি পড়েছে ঋণের ফাঁদে। সবাই বলছেন, অতীতের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ আর বর্তমানে রাজাপক্ষে পরিবারের গোষ্ঠীতন্ত্র, খামখেয়ালিপূর্ণ সিদ্ধান্ত, ভুল নীতি, ভুল প্রকল্প বাছাই ও দুর্নীতির কারণেই শ্রীলঙ্কা আজকের এ অবস্থানে। সচেতন মহলের মধ্যে অনেকেই মন্তব্য করছেন, বাংলাদেশের দশাও কি শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে? তবে আমরা মনে করি, সঠিক পরিকল্পনা না করে বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ, আমদানি বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পের ব্যয় নির্বাহ, প্রবাসী আয়ে ভাটা, ব্যাপক দুর্নীতি, রাজনৈতিক দলে সাধারণ কর্মী বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণের অভাব আর রাজনৈতিক অপশাসনের কারণে যেকোনো অঘটনের আশঙ্কাকে সম্পূর্ণ উড়িয়েও দেওয়া যায় না।

আমরা শুনে আসছি, চীনের ঋণের ফাঁদে বন্দী শ্রীলঙ্কা। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত থাকলেও বৃহৎ একাধিক অবকাঠামো প্রকল্প চীন থেকে ঋণ নিয়েই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। হামবানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য চীন থেকে ১৫ বছরের জন্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে, প্রায় উচ্চ সুদহারে ঋণ নিয়েছিল ৩০ কোটি ৭০ লাখ ডলার। কিন্তু এ সমুদ্রবন্দর থেকে আয় হয় সামান্য, যা ঋণ পরিশোধের জন্য যথেষ্ট ছিল না। সর্বশেষে চীনের কাছেই বন্দরটি ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়েছে। চীনের অর্থায়নে শ্রীলঙ্কায় যে বিমানবন্দর ও গভীর সমুদ্রবন্দর হয়েছে, তা শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি, কিন্তু চীনের লাভ হয়েছে।

আমাদের বাংলাদেশেরও সব প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগেই ভাবা উচিত এর অর্থনৈতিক ফায়দা কতটা। না ভেবে কোনো কাজে হাত দিলে এর ক্ষতির দায় যারই হোক ভুগবে সাধারণ মানুষ। তাই ক্ষমতাশীলদের আরও মাথা খাটিয়ে কাজ করতে হবে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মেগা প্রকল্পের বিকল্প নেই। কিন্তু মেগা প্রকল্পে, মেগা ঋণ? তাহলে আমরাও কি শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটছি? একসঙ্গে অনেক মেগা প্রকল্প হাতে না নেওয়াই উত্তম। এতে দেশ ঋণের জ্বালে জড়াবে না।

বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে আমরা মধ্যম আয়ের কাতারে প্রবেশ করেছি। ফলে ঋণের সুদহার বাড়তে শুরু করেছে। এ বাস্তবতায় আমাদের ঋণ গ্রহণ বা প্রকল্প প্রণয়নের ক্ষেত্রে সাবধান হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে। সবচেয়ে বড় কথা দুর্নীতি। সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও সুশাসন থাকলে আমরা বিপদ ও ঝুঁকি পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে পারব। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে গেলে কম সুদে আর ঋণ পাবে না বাংলাদেশ। মিলবে না বাণিজ্যে বিশেষ অগ্রাধিকার সুবিধা। নিতে হবে বেশি সুদের ঋণ। এতে দায় পরিশোধও বাড়বে।

শ্রীলঙ্কা ২০১৯ সালে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে নেমে গেছে। তার মানে শ্রীলঙ্কা যে উন্নতি করেছিল, তা তারা ধরে রাখতে পারেনি। শ্রীলঙ্কার দৃষ্টান্ত থেকে আমরা বুঝতে পারছি, দেশের অর্থনীতি স্বজনতোষী অর্থনীতিতে রূপ নিলে কী বিপদে পড়তে হয়, শ্রীলঙ্কার কাছ থেকে সে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।