জলবায়ু পরিবর্তন এবং আগামীর কৃষি

কাজ করছেন কৃষি শ্রমিকেরাফাইল ছবি: প্রথম আলো

জলবায়ু বলতে সাধারণত কোনো স্থানের ৩০ বছরের বেশি সময়ের আবহাওয়া, অর্থাৎ বায়ু, তাপ, বৃষ্টিপাত প্রভৃতির গড়কে বোঝানো হয়। অন্যদিকে আবহাওয়া বলতে কোনো স্থানের স্বল্প সময়ের, অর্থাৎ এক থেকে সাত দিনের বায়ু, তাপ, বৃষ্টিপাত প্রভৃতির গড় বোঝানো হয়ে থাকে। আবহাওয়া প্রতিদিন, এমনকি প্রতি ঘণ্টায় পরিবর্তিত হয়। অন্যদিকে কোনো স্থানের জলবায়ু পরিবর্তন হতে দীর্ঘ সময় লাগে। আবহাওয়ার বিস্তার স্বল্প পরিসরে ঘটলেও জলবায়ুর বিস্তার বিশাল পরিসরে ঘটে। তারপরও আবহাওয়া ও জলবায়ু একে অপরের পরিপূরক। আবহাওয়া ও জলবায়ু উভয়েরই কৃষিতে প্রভাব উল্লেখযোগ্য। জলবায়ু পরিবর্তন—ইদানীং শব্দটি বেশি শোনা যায়। জলবায়ু পরিবর্তন বলতে সাধারণত আবহাওয়ার চেনাজানা ধরন বদলে যাওয়াকে বোঝানো হয়। যেহেতু এই পরিবর্তন বিশাল পরিসরে ঘটে, তাই একে বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে পড়ছে, পরিবর্তন হচ্ছে গরম ও শীতের তীব্রতা ও ব্যাপ্তি। তাই দ্রুত বদলে যাচ্ছে আবহাওয়ার বহুদিনের চেনাজানা আচরণ। প্রভাব পড়ছে প্রকৃতি ও জীবজগতের ওপর। ধারণা করা হয়, জলবায়ুর এই পরিবর্তনে বদলে যাবে আমাদের জীবনযাপন। পানির সংকট তৈরি হবে, খাদ্য উৎপাদন কঠিন হয়ে পড়বে।

কোনো কোনো অঞ্চল বিপজ্জনক মাত্রায় উত্তপ্ত হয়ে পড়বে এবং সেই সঙ্গে সমুদ্রের পানি বেড়ে বহু এলাকা প্লাবিত হবে। এ কারণে সেসব জায়গা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে এবং খাদ্য উৎপাদন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। বিভিন্ন প্রজাতির অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়বে তাদের চিরচেনা আবহাওয়া বদলের কারণে। বর্তমানে গ্রীষ্মে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ ও শীতকালে তীব্র শীত এবং কোনো কোনো সময় অনাকাঙ্ক্ষিত গরম, শীতকালে মুষলধারে বৃষ্টি, বৃষ্টির দিনে কম বৃষ্টি, অকাল বন্যা, বন্যার দীর্ঘস্থায়ী অবস্থান, শিলাবৃষ্টি এ দেশের আবহমান আবহাওয়ার পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে।

প্রকৃতিগত কারণে স্বাভাবিকভাবেই জলবায়ুতে কিছু পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তন সহনীয় মাত্রায় ঘটে; কিন্তু অসহনীয় মাত্রায় এই পরিবর্তনের জন্য মানুষের কর্মকাণ্ডকেই প্রধানত দায়ী করা হয়ে থাকে। নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে মানুষ যখন কলকারখানা ও যানবাহন চালাতে বা শীতে ঘর গরম রাখতে তেল, গ্যাস ও কয়লা পোড়াতে শুরু করল, সেই সময়ের তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা এখন ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ঊনবিংশ শতাব্দীর তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। গত দুই দশকে বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। বনভূমি ধ্বংসের কারণেও বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন বাড়ছে।গাছপালা কার্বন ধরে রাখে। সেই গাছ যখন কাটা হয় বা পোড়ানো হয়, সঞ্চিত সেই কার্বন বায়ুমণ্ডলে নিঃসরিত হয়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, শিল্পবিপ্লব শুরুর আগে বিশ্বের যে তাপমাত্রা ছিল, তার থেকে বৃদ্ধির মাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা গেলে বড় ধরনের বিপদ এড়ানো সম্ভব। অন্যথায় বিপজ্জনক হয়ে পড়বে প্রকৃতি, পরিবেশ ও মানুষের জীবন। অনেক বিজ্ঞানীর আশঙ্কা, এই ভয়ংকর পরিণতি ঠেকানোর আর কোনো উপায় নেই এবং চলতি শতাব্দীর শেষে বিশ্বের তাপমাত্রা ৩ দশমিক ০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। এই বৃদ্ধির প্রভাব বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত নভেম্বরে গ্লাসগোতে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের ২৬তম কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস (কপ২৬) চলাকালে বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে নাগালের মধ্যে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমা নির্ধারণ করেছে।

বিশ্বব্যাপী অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তি ও প্যারিস চুক্তিতে বর্ণিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পূরণে কাজ করে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করে। ২০১৯ সালের উপাত্তমতে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে থাকে চীন (১১ হাজার ৫৩৫ মেগাটন)। তারপর যুক্তরাষ্ট্র (৫ হাজার ১০৭ মেগাটন), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (৩ হাজার ৩০৪ মেগাটন), ভারত (২ হাজার ৫৯৭ মেগাটন) ও রাশিয়া (১ হাজার ৭৯২ মেগাটন) (বিবিসি, ২০২১)। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সমঝোতায় না পৌঁছাতে পারলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় ঠেকানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এই বিপর্যয়ের প্রভাব বাংলাদেশকেও মোকাবিলা করতে হবে।

অন্যদিকে মিথেন হলো কৃষির কারণে নির্গত আরেকটি গ্রিনহাউস গ্যাস। বাংলাদেশের প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ জমিতে ধানচাষ হয়। ধান চাষাবাদের কারণে একদিকে যেমন গ্রিনহাউস গ্যাস মিথেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রাস অক্সাইড নিঃসরিত হয়, তেমনি ধানগাছ তার শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কার্বন ডাই-অক্সাইড ফর্মে এসব গ্যাস শোষণ করে থাকে। তা ছাড়া ধানের জমি থেকে নিঃসরণকৃত গ্যাস আধুনিক ও ক্লাইমেট স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তার সিংহভাগ প্রশমন করা সম্ভব। ব্রি’র মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবীর গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ও ধানচাষ প্রসঙ্গে এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন যে ধান চাষাবাদে মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ মিথেন উৎপাদনে ভূমিকা রাখে, বাকি ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ মিথেন মাটি থেকে আসে। জলাবদ্ধ জমিতে লেবাইল জৈব কার্বন ও মিথানোজেনিক ব্যাকটেরিয়া মিথেন উৎপাদন করে।

সুতরাং, ধানচাষের চেয়ে পতিত জমি মিথেন নিঃসরণের জন্য বেশি দায়ী। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুসারে, বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রধান উৎসগুলো হলো—বিদ্যুৎ ও জ্বালানি (৩১ দশমিক ৯ শতাংশ), পরিবহন (১৪ দশমিক ২ শতাংশ), উৎপাদনমুখী ও নির্মাণশিল্প (১২ দশমিক ৬ শতাংশ) ও কৃষি (১১ দশমিক ৯ শতাংশ)। প্রথম তিন উৎসই জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসৃত হয়, যা জমা হওয়া মোট গ্রিনহাউস গ্যাসের ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ। একটা বিষয় এ থেকে পরিষ্কার—গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ব্যাপক হারে কমাতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বন্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক শক্তি ব্যাপক হারে ব্যবহার শুরু না করলে কখনোই কাঙ্ক্ষিত নেট জিরো লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো যাবে না।

স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে ২৬তম জলবায়ু সম্মেলন বা কপ২৬–এ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ‘জলবায়ুবিষয়ক লিডার্স সম্মেলনে আমি যে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্র তা পূরণে সক্ষম হবে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কার্বন নির্গমন ২০০৫ সালের পর্যায়ের চেয়ে ৫০ থেকে ৫২ শতাংশ কমিয়ে দেবে।’ এখানে উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে কার্বন নিঃসরণের হার কমানো ও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের পরিমাণ হ্রাস করার কথা থাকলেও কোনো দেশই এখন পর্যন্ত এ বিষয়গুলো তেমন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়নি। এ কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে এবং এর সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এতে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো মারাত্মক অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ছে। বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব ইতিমধ্যে বাংলাদেশে দৃশ্যমান। কোনো দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব চারটি মানদণ্ডে বিবেচনা করা হয়, তা হলো—জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, কোথায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি হচ্ছে, সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা কোথায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশটি ক্ষতি মোকাবিলায় বা অভিযোজনের জন্য এরই মধ্যে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের এই ঘটনাকে বাংলাদেশ সরকারের বাংলাদেশ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় কর্তৃক নব্বইয়ের দশকে প্রণীত ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যানে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে সমুদ্র স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা সমস্যা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তন, বন্যা প্রভৃতি সব দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাত্রাও পরিবর্তিত হচ্ছে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। তাই বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় এ চার মানদণ্ডেই শীর্ষে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং তিনি জলবায়ু সংকটকে বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা হিসেবে যথাযথভাবেই অভিহিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বর্তমান সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড লিডারস সামিটে প্রেসিডেন্ট বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি নতুন উদ্যোগের ঘোষণা দেন। সেগুলো হলো—অভিযোজন ও ঝুঁকি-সহিষ্ণুতা বিষয়ে জরুরি পরিকল্পনা (প্রিপেয়ার), জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কৃষি উদ্ভাবন মিশন (এআএমফোরসি) এবং কার্বন শোষক হিসেবে বিশ্বব্যাপী বন সংরক্ষণের পরিকল্পনা। এআএমফোরসি হলো যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি যৌথ উদ্যোগ, যার আওতায় জলবায়ুবান্ধব কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থায় বিনিয়োগ বাড়বে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই এআএমফোরসিতে (দ্য অ্যাগ্রিকালচার ইনোভেশন মিশন ফর ক্লাইমেট) স্বাক্ষর করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পাঁচ বছরব্যাপী (২০২১-২০২৫) কৃষি উদ্ভাবন মিশনের উদ্দেশ্য হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় স্মার্ট কৃষিপ্রযুক্তি ও খাদ্যব্যবস্থা-বিষয়ক উদ্ভাবনে বর্ধিত বিনিয়োগ; বিনিয়োগের প্রভাবকে প্রসারিতকরণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদ্ভাবনের জন্য কারিগরি পর্যালোচনা ও দক্ষতা, জ্ঞান ও অগ্রাধিকারের প্রচারের জন্য ফ্রেমওয়ার্ক ও কাঠামোগত সহায়তা এবং উপযুক্ত কাঠামো স্থাপনের মাধ্যমে জলবায়ু-সম্পর্কিত কৃষি উদ্ভাবনে উপযুক্ত স্টেকহোল্ডার এবং দেশগুলোর মধ্যে গবেষণা ও সহযোগিতা সম্প্রসারণ। বাংলাদেশসহ বর্তমানে ৩৬ দেশের সরকার ও ৭৫টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এআইএম’র অংশীদার।

সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ আয়োজনে গত ২১ ফেব্রুয়ারি দুবাইয়ের ওয়ার্ল্ড এক্সপোতে অনুষ্ঠিত হলো জলবায়ুর জন্য কৃষি উদ্ভাবন মিশনের প্রথম মন্ত্রী পর্যায়ের সভা। অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাক অংশ নেন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করে কৃষি উৎপাদন ও খাদ্যনিরাপত্তা টেকসই করতে জলবায়ু প্রশ্নে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে উন্নত দেশগুলোকে আহ্বান জানান। মন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের ভূমিকা খুব কম হলেও এর কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ ক্লাইমেট স্মার্ট প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন ও খাদ্যনিরাপত্তাকে টেকসই করতে চায়। মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান ও ডেলটা প্ল্যান ২১০০–এ প্রচেষ্টার অংশ।জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কৃষিতে দৃশ্যমান এবং হুমকির মুখে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা। বীজ গজানো, পরাগায়ন ও পরিপক্ক হতে সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত ও সূর্যালোকের প্রয়োজন। জলবায়ুর এ উপাদানগুলো পরিবর্ধিত হচ্ছে, কিন্তু বীজ বপন ও চারা রোপণের সময় পরিবর্তন সম্ভব হয়নি। এ কারণে কৃষি মৌসুমের সঙ্গে ফসলের চাষাবাদ খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মিল রেখে স্থানভিত্তিক গবেষণা কার্যক্রমকে জোরদার করতে হবে। তা ছাড়া পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আরও দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

একটি হলো, প্রতিকূল পরিবেশে সহনশীল স্বল্প মেয়াদি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে ক্রমাগত বৃদ্ধিরত জনসংখ্যার জন্য খাদ্যের জোগান দেওয়া এবং অন্যটি পরিবর্তিত বিরূপ পরিবেশে কৃষিকে খাপ খাওয়ানো। ক্লাইমেট স্মার্ট প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পাশাপাশি কৃষি উৎপাদনব্যবস্থাকে পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে মিল রেখে টেকসই করতে খাপ খাওয়ানো বা অভিযোজন কৌশল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রচলিত চাষ পদ্ধতি ও শস্যপর্যায় পরিবর্তন করে পানি কম লাগে এমন ফসলের চাষ, ধানচাষে এডব্লিউডি বা পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও শুকানো প্রযুক্তির ব্যবহার, মালচিং ও ড্রিপ সেচের প্রবর্তন, অল্প চাষ বা বিনা চাষে উৎপাদন পদ্ধতিকে উৎসাহিত করা, ভাসমান ও উল্লম্ব চাষের মাধ্যমে প্লাবিত ও অনাবাদি জমি চাষের আওতায় নিয়ে আসা, ফসল চাষের সব পর্যায়ে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, স্বল্প জীবনকাল এবং তাপ-খরা-শীত-বন্যা-লবণসহিঞ্চু জাতগুলোর আবাদ এলাকা সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে স্মার্ট প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও টেকসই কৃষি উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কৃষকদের অভিযোজন কৌশল ও পরিবেশবান্ধব জৈবিক উৎপাদন কৌশলে আগ্রহী করে তুলতে সরকারি ও বেসরকারিপর্যায়ে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

*লেখক: ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট