জব্বারের বলীখেলা: বাঙালির জাতিসত্তার বুনিয়াদি ঐতিহ্য
বলীখেলা মাত্র দুজন প্রতিযোগীর মধ্যে অনুষ্ঠেয় একটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। এর আবার বিভিন্ন নাম, যেমন মল্লযুদ্ধ, কুস্তি প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। বাংলাদেশের কয়েকটি প্রধান জাতীয় খেলার মধ্যে বলীখেলাও একটি। অন্যগুলো যেমন হাডুডু, পরোখেলা বা দাড়িয়াবান্ধা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। বলীখেলাও যে বিলুপ্তির পথ ধরেনি, তা নয়। তবে এটি এখনো বেঁচে আছে চট্টগ্রামের লালদীঘির মাঠে অনুষ্ঠিত কুস্তি প্রতিযোগিতা বা জব্বারের বলীখেলার বদৌলতে। বলীখেলা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নাম। এর আভিধানিক নাম হচ্ছে মল্লযুদ্ধ বা কুস্তি প্রতিযোগিতা।
হাডুডু, পরোখেলা বা দাড়িয়াবান্ধা এবং মল্লযুদ্ধ বা বলীখেলা এ তিনটি জাতীয় খেলা। এ খেলাগুলো খেলতে গিয়ে খেলোয়াড়দের তেমন কোনো সাজ-সরঞ্জামের প্রয়োজন হয় না। আধুনিক খেলা বিশেষ করে ফুটবল, হকি, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, টেনিস, ভলিবল, বাস্কেটবল, রাগবি, টেবিল-টেনিস প্রভৃতি প্রায় খেলার জন্য কিছু না কিছু সরঞ্জামের প্রয়োজন। যেমন ফুটবল, ভলিবল, রাগবি, বাস্কেটবল খেলার জন্য বল, নেট, বার, বিশেষ ধরনের পোশাকের প্রয়োজন। তেমনি ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, হকি, টেনিস প্রভৃতি খেলার জন্য ব্যাট, বল, পোশাক, নেট, কক, বার, স্টিক প্রভৃতি সরঞ্জামের প্রয়োজন।
পক্ষান্তরে হাডুডু, পরোখেলা ও বলীখেলায় তেমন কোনো বিশেষ ধরনের পোশাক বা সরঞ্জামের প্রয়োজন হয় না। একমাত্র শারীরিক কসরতের মাধ্যমে এ খেলাগুলোর হারজিত নিশ্চিত হয়। আধুনিক খেলাগুলোর মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময়ও নষ্ট হয় না। অল্প সময়ের মধ্যেই এ খেলার ফলাফল পাওয়া যায়। তখনকার গ্রামীণ জীবনে এ তিন খেলাই ছিল যুবকদের কাছে বিনোদনের মাধ্যম।
মল্লযুদ্ধে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য সুপ্রাচীনকালের। এই মল্লক্রীড়া চট্টগ্রামে বলীখেলা নামে অভিহিত। মল্লযুদ্ধে যাঁরা অংশ নেন, তাঁদের বলা হয় কুস্তিগির। আর চট্টগ্রামের ভাষায় তাঁদের বলা হয় বলী। বলীখেলা চট্টগ্রামের একটি সুপরিচিত ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ক্রীড়ানুষ্ঠান, যা মধ্যযুগের মুসলমান শাসনামল থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সেকালে চট্টগ্রামের বলীখেলা তখনকার যুবক সম্প্রদায়ের কাছে অনেকটা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছিল। তখনকার বলীরা নিজেদের বলী পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন। চট্টগ্রামে আজও বহু বাড়ির পরিচিতিতে বলীর নাম যুক্ত আছে। যেমন ওয়ালীবলীর বাড়ি, সফরআলী বলীর বাড়ি ইত্যাদি। বলীদের তখন বেশ যশ–খ্যাতিও ছিল। বলীখেলা খেলতে হলে প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী হতে হয়। অন্যান্য আধুনিক খেলার মতো বলীখেলায় তেমন বেশি নিয়মকানুন নেই। দুই বলী প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে শারীরিক শক্তি ও কসরতের মাধ্যমে একজন আরেকজনকে মাটিতে ফেলে পিঠ লাগিয়ে দিতে পারলেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়ে যায়। বলীখেলার ভাষায় এটাকে বলা হয় ‘আছাড়’।
চট্টগ্রাম বলীর দেশ। চট্টগ্রামের প্রতিটি গ্রামে এককালে ছোট বা বড় আকারে বলীখেলা অনুষ্ঠিত হতো। দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়ার বলীখেলা, তুফান আলীর বলীখেলা, পরাণ সিকদারের বলীখেলা, ইলিস্যার বক্স হামিদের বলীখেলা, কৃষ্ণ নাজিরের বলীখেলা, টেগরপুণীর বলীখেলা, উত্তর চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বলীখেলা, নদিমপুরের বলীখেলা, ফতেপুরের বলীখেলা, মাদার্শার বলীখেলা প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
প্রতিবছর চৈত্র মাসের শেষার্ধে আর বৈশাখ মাসের প্রথমার্ধে আসে মাসব্যাপী বলীখেলার মৌসুম। সঙ্গে বসে আনন্দ মেলা। মেলায় বিভিন্ন পণ্যের আমদানি হয়।
হরদম চলে বেচাকেনা। পসারিরা তাঁদের পসরা সাজান ভ্রাম্যমাণ দোকানে। ব্যবসাও করে গেল বলীখেলাও দেখে গেল। অর্থাৎ রথও দেখা হলো কলাও বেচা হলো।
চট্টগ্রামের মতো সারা জেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামে চৈত্র-বৈশাখ দুই মাসব্যাপী উৎসব আকারে বলীখেলা বাংলাদেশের আর কোনো জেলায় প্রচলিত ছিল না। তখন চট্টগ্রামের একপ্রান্তের বলীরা অপর প্রান্তে অনুষ্ঠিত বলীখেলায় গাঁটের পয়সা খরচ করে যোগ দেওয়া হতো। বলীখেলার প্রতি চট্টগ্রামবাসীর এমন নেশা ছিল যে সেকালে জীবিকা উপলক্ষে চট্টগ্রামের দুই লাখ লোক ব্রহ্মদেশে (বর্তমান মিয়ানমার) প্রবাস জীবনযাপন করতো। কিন্তু বলীখেলার মৌসুম অর্থাৎ চৈত্র-বৈশাখ মাস এলেই তাদের একটি অংশ স্বদেশে চলে আসতো বলীখেলা দেখতে, খেলতে এবং আয়োজন করতে। তখন চট্টগ্রামে অনেক নামজাদা বলী ছিলেন—আনক্যা বলী, গইন্যা বলী, মিরা বলী, আছদ আলী বলী, আহমদ ছফা বলী, ওয়ালী বলী, ইয়াকুব বলী, সুলতান বলী, সফর আলী বলী, টুইক্যা বলী প্রভৃতি সুবিখ্যাত বলী ছিলেন।
সেকালে কোনো গ্রামে বলীখেলার আয়োজন করার আগে দিন–তারিখ ধার্য করে পার্শ্ববর্তী কয়েক থানার হাটবাজারে ঢোল–বদ্যসহকারে প্রচার অভিযান চালানো হতো। খেলা দাতারা বিজয়ী বলীর জন্য ডজনখানেক রুপার মেডেল তৈরি করত। সর্বশ্রেষ্ঠ বলীর জন্য সোনার মেডেল তৈরি করা হতো একটি। খেলার দিন খেলার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে, মাঠে অথবা বিলে সকাল থেকে ঢোল-বাদ্য বাজানো চলত। বেলা তিনটার মধ্যেই দর্শক ও বলীর দল ঢোল-বাদ্যসহকারে খেলার স্থানে পৌঁছে যেত। খেলার আয়োজকদের আয়োজন অনুসারে ৫-১২ দল অথবা ততোধিক বলীর দল আসত।
তাদের ঢোল-বাদ্যের খরচ খেলার আয়োজকেরাই বহন করত। খেলার শুরুতেই একজন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে সভাপতি করা হতো। বিজয়ী বলীর গলায় মেডেল পরিয়ে দেওয়াই ছিল তাঁর কাজ। খেলার প্রথম দিকে জুনিয়র বলীদের কুস্তি চলত। তাদের বলা হতো বলীদের সাহাব বা জুনিয়র বলী। দুই–তিনজন অবসরগ্রহণকারী বলী কুস্তির জোড় মিলিয়ে দিতেন। এক বলী তার প্রতিদ্বন্দ্বী বলীকে আছাড় (পরাজিত) দিয়ে মাটিতে পিঠ লাগিয়ে দিতে পারলেই জয়–পরাজয় নির্ধারিত হয়ে যেত। বেলা চারটার দিকে বলীদের খেলা আরম্ভ হতো। বিজয়ী বলীর গলায় মেডেল পরিয়ে দেওয়া হলে ৫-১০ মিনিট চলত বিজয়ী বলীর নাচ। সেকালে বলীর নাচ দর্শনীয় ছিল। ডক্টর ওয়াকিল আহমদ তাঁর ‘বাংলার লোক সংস্কৃতি’ গ্রন্থে চট্টগ্রামের বলীর নাচের কথা উল্লেখ করেছেন। সেকালে চট্টগ্রামের বলীখেলা তখনকার যুবক, আবালবৃদ্ধবনিতা—সবাইকে যেন মোহগ্রস্ত করে রাখত। চৈত্র-বৈশাখ মাস এলেই বলীখেলার ধুম পরে যেত।
চারদিকে সাজ সাজ রব শুরু হতো। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল থেকেই চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এই বলীখেলার অনুষ্ঠান ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। যুগের বিবর্তনে ও কালের পরিবর্তনে এটি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে আশার কথা, একমাত্র চট্টগ্রাম শহরের লালদীঘির মাঠে প্রতিবছর ১২ বৈশাখ অনুষ্ঠিত জব্বারের বলীখেলা বুনিয়াদি এই বিনোদনকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
চট্টগ্রাম শহরের বদরপাতি নিবাসী বক্সিরহাটের আবদুল জব্বার সওদাগর এ খেলার প্রতিষ্ঠাতা। ১৯১০ সালের ১২ বৈশাখ তিনি তাঁর বাড়ির নিকটস্থ লালদীঘির ময়দানে প্রথম এই বলীখেলার আয়োজন করেন। সেই থেকে এটি জব্বারের বলীখেলা নামে সারা দেশের মানুষের কাছে পরিচিত। প্রতি বাংলা সনের ১২ বৈশাখ আনুষ্ঠানিকভাবে বলীখেলার উদ্বোধন হয়। বলীখেলা উপলক্ষে লালদীঘির ময়দান কেন্দ্র করে বিশাল এলাকাজুড়ে বসে মেলা। আশপাশের পাকা রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এ মেলা হয়। বর্তমানে পেশাদার বলীর অভাবে বলীখেলার আকর্ষণ তেমন না থাকলেও জব্বারের বলীখেলার মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে খেলাকে ঘিরে মেলা। তাই অনেকে বলীখেলার পরিবর্তে এটাকে বৈশাখী মেলা হিসেবেই জানে। জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা চট্টগ্রামের বুনিয়াদ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অহংকারে পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়। খেলাকে কেন্দ্র করে তিনদিনের আনুষ্ঠানিক মেলা বসার কথা থাকলেও কার্যত পাঁচ-ছয়দিনের মেলা বসে লালদীঘির ময়দানের চারপাশের এলাকাজুড়ে। এটির বিস্তার বর্তমানে বাড়তে বাড়তে উত্তর দিকে আন্দরকিল্লার মোড়, দক্ষিণে কোতোয়ালীর মোড়, পূর্বে বক্সিরহাট ও পশ্চিমে রিয়াজউদ্দিন বাজার আমতলা পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে। এই বিশাল এলাকায় বসে চারু ও কারুশিল্পের মেলা। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হস্তশিল্প, কুটির শিল্প, মৃৎশিল্প ও গৃহস্থালি পণ্যসামগ্রীর আমদানি হতে থাকে মেলার তিন-চারদিন আগে থেকে। সারা দেশ থেকে আসা পসারিরা রাস্তার ওপর ফুটপাতজুড়ে যে যেখানে জায়গা পান, সেখানে বসেন তাঁদের পসরা নিয়ে।