জন্মনিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে কেন এত কালক্ষেপণ
জন্মগতভাবেই আমাদের আছে মৌলিক সব অধিকার পাওয়ার ন্যাযতা। সে জন্য দেশে–বিদেশে সহজে চলাফেরা করার নিমিত্তে সমুদয় যথাযথ প্রক্রিয়াসম প্রয়োজনীয় সনদপত্রাদিও দীর্ঘসূত্রতাবিহীন সহজে পাওয়াও নাগরিকের অন্যতম সেবা বটে। আর এ পরিপ্রেক্ষিতে শিশুর জন্মক্ষণে যে জন্মনিবন্ধন সনদ সঙ্গে সঙ্গে হাতে পাওয়ার কথা, তা পেতে যেন এখন প্রসবব্যথার মতো বেগ পেতে হয়। কিন্তু এমন হওয়ার কি আদৌ দরকার আছে? বিজ্ঞজনেরা বলেন, ‘রাষ্ট্র যে ভার বইতে জানবে না, সে ভার নেওয়া আদৌ উচিত কি না, তা রাষ্ট্র কার্যনির্বাহী পদক্ষেপ কতটা মসৃণ ভাবনার বিষয়।’
পৃথিবীর অন্য রাষ্ট্রগুলো জন্মের প্রথম দিনই যেখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শিশুর জন্ম নিবন্ধন করে ফেলে এবং সে অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার সঙ্গে নতুন সংখ্যা যোগ হয়ে হিসাব সরলীকরণ করা হয়। সঙ্গে সঙ্গেই আর আমরা এ ডিজিটাল বাংলাদেশে বসে এখন কী করছি ভেবে দেখা দরকার। জন্মনিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতে যে কালক্ষেপণ করেন আমাদের সরকারের সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা, তাতে মনে হয় মহামান্য সরকার তাঁদের ওপর পুরো রাষ্ট্রের যাবতীয় কাজকর্ম মাথায় বোঝা হিসেবে তুলে দিয়েছেন। এত হয়রানি ও গড়িমসি কী কারণে? অনেক সময় দেখা যায় সরকার–নির্ধারিত ফি থেকেও কয়েক গুণ বেশি জনগণ থেকে আদায় করা হয়, যা এখন ওপেন সিক্রেট বলে বিবেচিত।
বাংলাদেশ নামে ডিজিটাল হওয়া জনগণ কখনো আশা করে না। রাষ্ট্রের প্রতিটি কাজে তার ছাপ থাকা দরকার। একটি জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে মানুষকে জায়গার দলিল থেকে শুরু করে বাড়ির বিদ্যুৎ বিল, নিকট আত্মীয়স্বজনের তল্লাশি কাগজপত্রসহ আট থেকে দশটি প্রামাণ্য দলিল দরকার পড়ে। কী কারণে অহেতুক এই হয়রানি, জনগণ অসহায়ের মতো জানতে চায়। এ যেন আটপৌরে শ খানেক কাব্য রচনার মতো প্রক্রিয়া। এত কাগজ কেন দরকার ভোটার হওয়ার অধিকার পেতে এ দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও? অথচ জন্মক্ষণে এসব প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেলে, বালাম খাতায় নাম উঠে গেলে এমন হয়রানিতে পড়তে হতো না। এমন করে কি আদৌ সহজীকরণ সম্ভব নয়? আর কত যাতনার শিকার হবে সাধারণ মানুষ? রোহিঙ্গাদের বেলায় যে নিয়ম প্রযোজ্য, তা কেন দেশে জন্ম নেওয়া প্রকৃত নাগরিকের ওপর বর্তাবে? উপরন্তু, জন্মনিবন্ধন সনদ আর জাতীয় পরিচয়পত্র দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর শেষমেশ হাতে এলেও দেখা যায় হাজারো বানান ভুল! এ যেন পেয়েও তারে পেলাম না, এমন দশা। এসব জাতীয় কাজ করানোর জন্য কতটুকু যোগ্যতাসম্পন্ন লোকবল নিয়োগ করা হয়েছে, তা প্রশ্ন থেকে যায়। যে লাউ সেই কদু। ফের বানান নির্ভুল করতে বছর খানেক তো লেগেই যায়।
আমি নিজেও ভুক্তভোগী। কেন এত বানান ভুল হবে? বিদ্যমান পোস্টে চাকুরে কি ন্যূনতম লেখাপড়া না করেই চাকরিতে অফিশিয়ালি এসেছেন, নাকি অসদুপায়ে জায়গা করে নিয়েছেন, তা জানা খুব জরুরি বৈকি। স্কুলের শিক্ষকের কাছে যখন স্বাক্ষর নিতে যান জনগণ, তখন মাস্টার সাহেব সদয় হয়ে হাজারো সরকার–নির্ধারিত জন্মনিবন্ধন ফর্ম নিজেরা হাতে লিখে দেন নির্ভুল হওয়ার জন্য, যা শিক্ষকের আওতাভুক্ত কাজ নয়। স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজেও অনেককে লিখে দিয়েছি, যাতে কম্পিউটার মহাশয় ভুল না লেখেন। আসলে লেখেন কারা, নিশ্চয়ই মানুষ অপারেটিং সিস্টেমে থাকেন!
তাড়াহুড়ো করে যেনতেন একটা নাম লিখে দিলেই তো আর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। যেমন ‘করিম’ বানানে হরহামেশাই দেখেছি ‘খরীম’ বা ‘করীম’! ‘আখতার’–এর জায়গায় লেখা হয়েছে ‘মোক্তার’! ‘মমতাজ’–এর জায়গায় ‘আলতাজ’! এসব কি কর্তব্যে অবহেলা নয়? আর এ বিষয়গুলো নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই উল্টো খেপে যান মহামান্য চাকুরে। জনগণকে ধমক দিতেও তাঁদের বিন্দুমাত্র বিবেকে বাধে না। অহেতুক তাঁদের বেতন দিয়ে পোষে কেন সরকার, তা জানতে চায় জনগণ।
বাংলাদেশের জনগণ চায় জন্মনিবন্ধন সনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্র জন্মক্ষণেই অটোমেটিক হয়ে যাক। যেহেতু এই দুটো কাগজ ছাড়া কোথাও কোনো সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় না, তাই প্রয়োজনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখে প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ দিক ওয়ার্ডভিত্তিক। শিশুর জন্মের কয়েক দিনের ভেতর শিশুর সব তথ্য নথিবদ্ধ হলে সেই অনুয়ায়ী জন্মনিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র তথা স্মার্ট কার্ড হয়ে যাবে নির্ভেজালভাবে। এতে জনগণের দুর্ভোগ অনেকটা লাগব হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে কিছু মানুষ বয়স হেরফের করে ডাবল সংশোধনী করে জাল সনদ তৈরি করতে পারবে না। যদিও অনলাইনে ডেটাবেইসে এন্ট্রি সব তথ্য একবারেই হয়ে যায়, তবু দুর্বৃত্তরা অপচেষ্টা চালায়, সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থাবেষ্টনী ভেঙে ফেলতে মরিয়া হয়ে ওঠে অর্থলোভে।
আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। অযথা কেন জনগণের নিজভূমে নিজের অধিকার ভোগ করতে এত বেগ পেতে হবে? বিষয়টি অতি সামান্য না ভেবে যথাযথ গুরুত্ব দিক বর্তমান জনগণের সরকার। মানুষ স্বস্তি ও শান্তিতে সরকারি সেবা উপভোগ করুক।
*লেখক: পারভীন আকতার, শিক্ষক ও কবি