ছাত্রনেতারা নিজ ক্যাম্পাসে চাকরি চাইছেন কেন
প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া একজন সাধারণ ছাত্র নিজের নেতৃত্বগুণ ও রাজনৈতিক মেধার জোরে একসময় হয়ে ওঠেন ছাত্রনেতা। পরিণত হন শত শত ছাত্রছাত্রীর অলিখিত অভিভাবক। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অধিকার ও দাবি নিয়ে তাঁরা কথা বলেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁদের গুরুত্ব দেয়। তাঁদের হাত করতে চায়। কিন্তু পুরো ক্যাম্পাসে ছাত্রনেতা শুধু একজন নয়, বেশ কয়েকজন হয়। তাঁদের মতের বিরোধ থাকে। তাঁরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক হন। কিংবা একই রাজনৈতিক দলের ভিন্ন ভিন্ন নেতার রাজনীতি করেন। বিভিন্নভাবে একে অপরের থেকে নিজেকে শক্তিশালী প্রমাণ করতে চান। (নিজের হলকে শক্তিশালী দেখাতে কিংবা একই হলের ব্লকের নিজের আয়ত্তে সিটসংখ্যা পরিমাণ দেখিয়ে মারামারি কিংবা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন।) গোলযোগ পাকিয়ে যায় সেখানেই। শক্তিশালী প্রমাণ করতে গিয়ে তাঁরা ছাত্ররাজনীতি থেকে অনেকটা ছিটকে গিয়ে শিক্ষকরাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তাঁরা (ছাত্রনেতারা) শিক্ষকসংগঠনগুলোর আস্থাভাজনে পরিণত হয়ে যান। ছাত্রদের অধিকার আদায়ের কথা ভুলে নিজের অধিকার আদায়ে মগ্ন হয়ে যান।
ঠিক তখনই তাঁদের ব্যবহার করে, রোদ-বৃষ্টিতে ভিজিয়ে বিক্ষোভ, মিছিল, মিটিং, সভা-সমাবেশ করিয়ে ফায়দা লুটতে থাকে শিক্ষকসমাজ। কখনো শুধু মিছিল মিটিংয়ে তাঁরা সীমাবদ্ধ থাকেন না, তাঁরা এক শিক্ষকদের কথায় অন্য শিক্ষকদের হুমকি-ধামকিসহ নানা নিকৃষ্টতর কাজে জড়িয়ে যান। তাঁরা পরিণত হন শিক্ষকসংগঠনের শিক্ষকদের নোংরা রাজনীতির খেলার পুতুলে।
এসবের বিনিময়ে তাঁদের মিলছে নাম-দাপট। স্যারের সঙ্গে একই গাড়িতে ঘোরাফেরা, ছবি তোলা। এ দাপট, যেটা অনেকাংশেই ক্যাম্পাসেই সীমাবদ্ধ। মেলে সামান্য অর্থও। তবে বেশির ভাগ টাকা আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের ঠিকাদারের পকেট থেকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কার্যক্রমে থেকে কিংবা বিভিন্ন জাতীয় দিবসের বরাদ্দের কিছু অংশ থেকে। যার বেশির ভাগই যায় জুনিয়রদের চা-সিগারেটের বিলে, বাইকের তেলে কিংবা মিছিল-মিটিংয়ে শেষে মিষ্টিমুখের ছলে। বাকিটা শীতে শীতবস্ত্র, বৃক্ষরোপণ ও মানুষ দেখানো কিছু কাজের মাধ্যমে সংবাদের শিরোনাম হওয়ায়।
কী কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা? পড়াশোনা! সেটা বাদে সবই হয়। দেখা যায় মিছিলের সামনে ব্যানার হাতে, মিটিংয়ের মধ্যমণি হতে, শিক্ষকদের সভা-সেমিনারে অডিটোরিয়ামের সামনের সিটে আর সুযোগ মিললে বজ্রকণ্ঠে জোরালো বক্তব্য দিতে। দেখা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফুল হাতে রাস্তার পাশে অপেক্ষা করতে। কারণ, নেতার এসি গাড়ি আসবে কয়েক মিনিটের জন্য কালো কাচ নামিয়ে হাসি হাসি মুখে দুইটা কথা বলবে। নতুবা দেখা মেলে ফুল হাতে বিভিন্ন জাতীয় দিবসে সম্মান জানাতে। এবং চা সিগারেটের আড্ডায়।
গড়ে প্রায় ৫ শতাংশ ছাত্রনেতা দামি সার্টিফিকেট অর্জন করতে পারলেও বাকিদের অবস্থা খুব একটা ভালো হয় না। বলা চলে শোচনীয়। এদিকে চাকরির পড়াশোনাটাও ঠিকভাবে করা হয়ে ওঠে না। কিন্তু চাকরি তো লাগবেই। হারিয়ে ফেলেন নিজের আত্মবিশ্বাস। ভুলে যান একসময় হাইস্কুল টপার ছিলেন। ফলে তাঁরা শিক্ষকদের দেওয়া টোপ গিলে ফেলেন। নো চাঁদাবাজি। বন্ধ করো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ। বিনিময়ে পাবেন চাকরি। ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তাঁদের নির্দেশ অনুযায়ী চলতে হবে।
যদি টোপ না গেলে, তবে অন্য কোথাও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে চাকরি পেতে হলে সেই ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া সোনার ছেলেটা হতে হবে। বছর খানেক তো তাতেই যাবে। পড়াশোনা শেষ করে পরিবার থেকে টাকা নিয়ে বছর খানেক পড়াটা সবার হয়ে উঠবে না। পারিবারিক চাপ, হতাশা, লেজ কাটা শিয়ালের রূপে নিজেকে মেলানো খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। একসময়ের ভরপুর কমেন্ট বক্স শূন্য হয়ে পড়বে। এসব ভাবতেই বুকটা ধুকপুক করে ওঠে। সবকিছু হারানোর থেকে নিজেকে বিকিয়ে দিয়ে একটা নবম বা দশম গ্রেটের চাকরি কি ভালো না! (অফিসার, সেকশন অফিসার, অ্যাকাউন্টস) ক্যাম্পাসেই থাকা হলো, জুনিয়রদের জুনিয়র করে বসে রাখা গেল। কিছুদিন পরে বিয়ে করে কোয়ার্টারে উঠে বিন্দাস লাইফ।
তবে এই পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে চাকরির টোপটা গিলে ফেলে নিজেকে কতটা ছোট করে ফেলে, সেটা তাঁদের চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যায়। দূর থেকে আঙুল উঁচিয়ে যখন কোনো জুনিয়র বলে, ‘এই সেই, যে ভিসির দালালি করে চাকরি পেয়েছে। গত ভিসির দালাল।’ খুব ইচ্ছে হয় তাঁদের জিজ্ঞাসা করতে কেমন লাগে তখন?
তার উত্তরে হয়তো এটা হবে, আমি গ্র্যাজুয়েশন করেছি। আমার যোগ্যতা আছে। আমি আবেদন করেছি। আমার চাকরি হয়েছে। আমি ছাত্রনেতা কিংবা সাংবাদিক বলে কি আবেদন করতে পারব না? এটা কেমন নিয়ম!
ভুল বলেনি, এটাও ঠিক। তাঁরা ও আবেদন করাতে পারেন। চাকরি পেতে পারেন। আবার যদি চাকরি হবে হবে করে না হয়? ভিসির মেয়াদ শেষের দিকে। তাঁরাই ভিসিকে চাপ দেন। বাসভবনে তালা লাগান। মধ্যরাতে তখন ভিসিকে বাসভবন ছাড়তে হয়। লিয়াজোঁ অফিস থেকে ক্যাম্পাস চালাতে হয়।
এসবের পেছনে ছাত্রদের যতটা না ক্ষমতা আর দাপটের লোভ দায়ী, তার থেকে শিক্ষকসমাজ বেশি দায়ী। প্রথম বর্ষে বড় ভাইয়ের র্যাগের মুখে কান্না করে দেওয়া ছেলেটা চার বছরে কি এত বড় হয়ে যায় যে শিক্ষকের গায়ে হাত তোলার মতো দুঃসাহস দেখান? প্রশাসনিক ভবনে তালা লাগান। একজন ভিসি, একজন রেজিস্ট্রার, একজন প্রক্টর, একজন অধ্যাপক যতক্ষণ নিজের সাঙ্গোপাঙ্গ আশা করবেন না, ততক্ষণ চাকরিপ্রত্যাশী কেউ জন্ম নেবে না। তাঁরা তাঁদের সেই পথে হাঁটান, তবেই তাঁরা হাটেন।
মাঝেমধ্যে ছাত্রনেতারা জোরপূর্বক চাকরি চেয়ে বসেন। তাঁদের চাপের মুখে চাকরি দিতে ইচ্ছা পোষণ করতে হয়। এ রকম হলে সেই প্রশাসনের কর্তার অযোগ্যতা ফুটে ওঠে। এটার জন্যও সেই শিক্ষকসমাজেই দায়ী।
লেখক: মো. সোয়াদুজ্জামান সোয়াদ, শিক্ষার্থী, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়