চোখে দেখা: ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ
অনেক দিন বিশ্বরাজনীতির খবর রাখি না। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ যে দীর্ঘমেয়াদি হচ্ছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এ একতরফা যুদ্ধে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ যে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এটা নিয়ে দ্বিমত করার সুযোগ নেই।
করোনা–উত্তর সময়ে অর্থনৈতিক মন্দা ও বাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতার কারণে একটা যুদ্ধের আশঙ্কা নিয়ে অনেকেই কথা বলেছিল। তবে এ যুদ্ধ যে খোদ ইউরোপের প্রাণকেন্দ্রে হবে, তা নিয়ে কেউ ভাবেনি।
সবার ধারণা ছিল, চীন–আমেরিকার মধ্যে বিরাজমান শীতল বাগ্যুদ্ধ হয়তো অস্ত্রযুদ্ধের দিকে মোড় নিতে পারে। বিশেষ করে হংকংয়ের উত্তেজনার মধ্যে চীন–আমেরিকার এ যুদ্ধ অনেকটা প্রত্যাশিত ছিল।
মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনকে যেভাবে ইসরায়েল দখল করে আছে, ঠিক সেভাবে রাশিয়া ইউক্রেনের একটা অংশ দখল করার পরিকল্পনা করছে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলে নেওয়ার পর রাশিয়া বর্তমান যুদ্ধে ইতিমধ্যে ইউক্রেনের দুটি অংশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। যুদ্ধের পরিক্রমা বলছে, ইউক্রেন বশ্যতা স্বীকার না করা পর্যন্ত রাশিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।
আমেরিকা বা ন্যাটোর ইউক্রেন কৌশল নিয়ে শুরু থেকেই ধোঁয়াশা ছিল। যুদ্ধ যত এগোচ্ছে, তত বোঝা যাচ্ছে, ন্যাটো বা আমেরিকা কোনোভাবেই ইউক্রেন যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করবে না।
ইউক্রেনের এ পরিণতির জন্য আমেরিকা বা ন্যাটো কতটা দায়ী, তা নিয়ে অবশ্য আমি আলোচনা করতে চাই না। তবে তাদের সহায়তার আশ্বাসে ইউক্রেন রাশিয়ার ব্যাপারে উদাসীন ছিল, এটা আমার কাছে পরিষ্কার। এখনো আমেরিকার অস্ত্র ইউক্রেনকে আলোচনার টেবিলে ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে শক্ত অবস্থানে রেখেছে, এটাও বলা যায়। তবে রাশিয়া যা করছে, তা এক দিনের পরিকল্পনা নয়। নানা সময়ে তারা ইউক্রেনকে পশ্চিমাদের কাছ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছে। আর এই করোনা–উত্তর মন্দার সময়ে তারা এ সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে চেয়েছে।
বিশ্বরাজনীতিতে আমেরিকার একচ্ছত্র আধিপত্য শেষ হতে যাচ্ছে, এটা নিয়ে অনেক দিন থেকেই কথা চলছিল। বিশেষ করে অর্থনীতিতে চীনের এগিয়ে যাওয়া এবং চীন রাশিয়ার জুটি ক্রমেই আমেরিকার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল। ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে তা প্রকাশ্যে আসায় আমি তাই অবাক হয়নি।
ব্রেক্সিট বা ম্যার্কেলের মতো নেতা না থাকার কারণে ইউরোপ এখন অনেকটাই নেতৃত্বহীন। সঙ্গে ট্রাম্পের কারণে বিশ্বরাজনীতি থেকে পিছিয়ে পড়া আমেরিকার গুছিয়ে উঠতে সময় লাগছে। এসব কারণ ছাড়াও রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা পুতিনকে বেশ আত্মপ্রত্যয়ী করেছে। তাই ইউক্রেনকে আসলে পরাজয় মেনে রাশিয়ার অনুগামী হতেই হবে।
বিশ্বক্ষমতায় যে প্যারাডাইম শিফট হচ্ছে, তাতে রাশিয়া আর চীনকে বাদ দিয়ে কিছুই করা সম্ভব নয়। তবে চীননির্ভর শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া হয়ে যাওয়া চীনের জন্য বড় আঘাত হতে পারে। শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশকেও মাশুল গুনতে হয় কি না, তা নিয়ে টুকটাক কথা হচ্ছে। বিশেষ করে পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রজেক্টে চীনের বড় অনুদান এবং এ ঋণ বাংলাদেশ কীভাবে শোধ করে, তার ওপর নির্ভর করে আগামীর বাংলাদেশ।
চীন বা রাশিয়ানির্ভর দেশগুলোর সাফল্য রাশিয়া-চীন জুটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে একটা ব্যাপার হতে পারে, এ সুযোগে চীন শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোকে পুরো কবজায় নিয়ে নেবে। চীনের এ কৌশল অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান হলে আমি অবাক হব না।
করোনা–উত্তর এই বিশ্ব যে চীন-রাশিয়ার অর্থ বা অস্ত্রের কাছে নতজানু হবে, তা ইউক্রেনের যুদ্ধ বা শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া হওয়া বলে দিচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, আমেরিকা কীভাবে ত্রাতার ভূমিকায় আসে। আমেরিকাও হয়তো এ সুযোগে তাদের নীতি নতুন করে সাজাবে।
আমেরিকায় থেকে আমার একটা জিনিস খুব করেই মনে হয়েছে, আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি অনেক শক্তিশালী। তারা নিজেদের লাভ ছাড়া অন্য কিছু করে না। আমেরিকা দান করলেও সেখানে স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। ইউক্রেনকে ব্যবহার করে রাশিয়াকে একঘরে করার এ কৌশলে এখনো আমেরিকা এগিয়ে। বিভিন্ন অবরোধ রাশিয়ার অর্থনীতির জন্য একটা বড় হুমকি হবে, তা সহজেই বলে দেওয়া যায়। তবে রাশিয়ার ওপর ইউরোপের জ্বালানি নির্ভরশীলতা ইউরোপকে অনেকটা কোণঠাসা করে রেখেছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপের চুপ থাকার কারণগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।
রাশিয়া ইউক্রেন দখল করতে পারলে তা কোনোভাবেই ইউরোপের জন্য সুখকর হবে না। পূর্ব ইউরোপের নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে, এটি বলা যায়। বিশেষ করে লাটভিয়া, লিথুনিয়া বা রোমানিয়ার মতো দেশগুলো বিপদে পড়তে পারে। আর রাশিয়া যে তাদের সম্প্রসারণ নীতি অব্যাহত রাখবে, এটিও অনুমান করা যায়।
বিশ্বরাজনীতির ফলাফল যা–ই হোক, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। যুদ্ধে যে পক্ষই জয়ী হোক, হেরে যায় মানবতা। আশা করছি, সব পক্ষই মানবিক হবে এবং শিগগিরই যুদ্ধ বন্ধ করে আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যার সমাধান করবে।
লেখক: ড. মো. ফজলুল করিম, সহযোগী অধ্যাপক, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল