চাইলেই করোনা-টিকা দেশে উৎপাদন করা যায়
প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন পড়ছিলাম। বলা হয়েছে, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ছয় ধরনের টিকা উৎপাদন করত। বিশ্বের এই অঞ্চল থেকে গুটিবসন্ত নির্মূলে রাজধানীর মহাখালীর এই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত টিকার বিশেষ ভূমিকা ছিল। ১০ বছর আগে মহাখালীর এই প্রতিষ্ঠানটি সর্বশেষ জলাতঙ্ক রোগের টিকা উৎপাদন করেছিল। তারপর টিকা উৎপাদন করার কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এখন বিদেশ থেকে টিকা এনে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে (ইপিআই) ব্যবহার করা হয়।’
ওপরের এই প্রতিবেদনটি যতবার পড়ছি ততবার মনে হচ্ছে, আমরা জাতি হিসেবে আসলে কী চাই? আমরা কেন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকেজো করে দিই? কোন উত্তর খুঁজে পাই না। তবে এতটুকু বুঝতে পারি আমাদের দেশের শিক্ষা ও গবেষণায় আমাদের কোনো নজর নেই।
পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে, বিশেষ করে যারা এগিয়ে গেছে তাদের এ রকম একটি টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থাকলে তারা এই প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে যেত অন্য মাত্রার উচ্চতায়। করোনার এই মহামারিতে তারা টিকা উৎপাদন করে নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করত। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা এখান থেকে যোজন যোজন দূরে।
করোনা দ্রুত চলে যাবে এমন কোনো লক্ষণ নেই। এমনও হতে পারে এটি সর্দি–কাশির মতো আরও একটু কঠিন উপসর্গ বা জটিলতা নিয়ে রয়েই গেল। আমরা এটাও জানি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমরা যে ফ্লু শট দিই, তার ইমিউনিটিও খুব বেশি দিনের জন্য নয়। যার কারণে আমাদের প্রতিবছর ফ্লু শট দিতে হয়। করোনাভাইরাসের এ টিকাও যদি বছর বছর দিতে হয় তবে আমাদের কেমন হবে? আমরা কি সব সময় বাইরে থেকে টিকা কিনে এনে জনগণকে দেব?
আমাদের মতো গরিব দেশের এত টাকা নেই যে সরকার বিরাট সংখ্যার এই মানুষকে বিনা খরচে প্রতিবছর টিকা দেবে। আবার সাধারণ মানুষেরও এত টাকা নেই যে তারা এই টিকা নিজ খরচে দেবে। তাই আমাদের দরকার নিজ দেশে টিকা উৎপাদন করা। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট পারলে আমরা কেন পারব না?
আমাদের একটি বড় সমস্যা হলো আমরা আমাদের অগ্রাধিকার খাত নির্বাচন করতে জানি না। আমরা শিক্ষা খাতকে বড় অবহেলা করি। আমরা গবেষণায় টাকা খরচ করতে চাই না। আমাদের প্রচুর মানবসম্পদ রয়েছে, যারা বাইরে কাজ করছে এবং তাদের জ্ঞান দিয়ে বাইরের দেশকে সেবা দিচ্ছে। তারা চাইলেও দেশে আসতে পারে না। কারণ দেশ তাদের কাজে লাগানোর মতো কোনো উৎসাহ দেখায় না। শুধু সরকার নয়, প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্টও আমাদের গবেষণা খাতে টাকা খরচ করতে চায় না। ভারত আজ টিকা উৎপাদনে সেরার কারণ হলো তাদের প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট। ১৯৬৬ সালে একজন মাত্র ব্যক্তির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই সেরাম ইনস্টিটিউট নামের কোম্পানি এখন শুধু ভারতের প্রয়োজন মেটাচ্ছে না, তারা অন্যান্য দেশেও করোনা টিকা রপ্তানি করছে। আমাদের দেশেও বড় বড় ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আমাদের কোম্পানিগুলোও নিজস্ব প্রয়োজন মিটিয়ে ওষুধ বিদেশে রপ্তানি করছে। এই কোম্পানিগুলো যদি এগিয়ে আসে তবে আমরা সহজেই সেরাম ইনস্টিটিউটের মতো বড় টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারি। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সময় এসেছে।
করোনাভাইরাসের টিকা সংকট থেকে আমরা আমাদের অগ্রাধিকার খাত নির্বাচন করবার শিক্ষা নিতে পারি। পাশের দেশ ভারত করোনা টিকা তৈরি করছে এবং তারা অক্সফোর্ডের সঙ্গে কলাবোরেশন করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় টিকা উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই টিকার মাধ্যমে নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে আমাদের কাছে রপ্তানি করছে। ভারত যদি পারে, তবে আমরা কেন পারব না? আমাদেরও দক্ষ গবেষক রয়েছে। আমাদেরও দক্ষ বায়োকেমিস্ট, ফার্মাসিস্ট এবং মাইক্রোবায়োলজিস্ট রয়েছে। আমরা চাইলেই তাদের কাজে লাগাতে পারি।
মেসেঞ্জার আরএনএভিত্তিক টিকার আইভিটি টেকনোলজি ব্যবহার করে আমার নিজেরও গবেষণা পেপার আছে। আমার ধারণা শুধু আমি নই, সরাসরি টিকা নিয়ে কাজ করা এ রকম অনেক বাংলাদেশি গবেষক দেশে–বিদেশে রয়েছে। তারা কাজ করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। শুধু দরকার তাদের জন্য কাজের ক্ষেত্র তৈরি করা।
স্পুতনিক-টিকার উৎপাদন করার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তির কথা শুনেছি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ যদি সত্যি সত্যি ভ্যাকসিন উৎপাদন করে নিজের প্রয়োজনও মেটাতে পারে তাহলেও এটা অনেক বড় কাজ হবে। আশা করব এই চুক্তিটি শুধু কাগজে চুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না।
টিকা উৎপাদন করতে গেলে অবকাঠামোর সঙ্গে সঙ্গে দরকার দক্ষ জনবল। আমাদের তাই কর্ম কৌশল ঠিক করতে হবে। আমরা প্রয়োজনে দেশে–বিদেশে থাকা বাংলাদেশি গবেষকদের সঙ্গে কথা বলতে পারি। তা ছাড়া আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান বাড়াতে হবে। ইন্ডাস্ট্রি একাডেমিয়া সম্পর্কের উন্নতি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় বিস্তার নয়, বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ালিটি বাড়াতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমাদের গোল ঠিক করতে হবে। জানতে হবে আমরা কী চাই?
আমাদের জনস্বাস্থ্যের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি পুনরুজ্জীবিত করবার জন্য আমাদের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এর সঙ্গে আমরা একটি বিশ্বমানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান করতে পারি, যেখানে কাজ করবে শুধু অভিজ্ঞ গবেষকেরা। অনার্স বা মাস্টার্স পাস করা ছাত্র নয়, এই প্রতিষ্ঠান শুরু হবে দেশি–বিদেশি উচ্চ মানের গবেষক দিয়ে। এখানে গবেষকদের আউটপুট বেইজড প্রমোশন হবে। এখান থেকে তৈরি হবে নতুন নতুন টিকা, যার মাধ্যমে যেন আমরা ভবিষ্যৎ মহামারি মোকাবিলা করতে পারি।
শেষে বলতে চাই আমাদের এখনই টিকা তৈরি শুরু করতে হবে। করোনা টিকার উৎপাদন দিয়ে যদি আমরা শুরু করতে পারি, তবে এই যাত্রা আমাদের নিয়ে যাবে বহুদূর।
লেখক: ড. মো. ফজলুল করিম, সহযোগী অধ্যাপক, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল, বাংলাদেশ। ভূতপূর্ব: ফ্যাকাল্টি, কুমামতো বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান এবং পোস্ট ডক্টরাল ফেলো, পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র।
এবং ড. জুবায়ের রহমান, মলিকিউলার ইমিউনোলজিস্ট, এনআইএইচ, যুক্তরাষ্ট্র।