‘চট্টগ্রামের সিআরবিতে চাই গাছের অক্সিজেন, হাসপাতাল নয়’

চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকার শিরীষতলা
ছবি: প্রথম আলো

বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ব্রিটিশ আমলের সিআরবি ভবন ঘিরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষের গাছপালা, পাশেই পিচঢালা আঁকাবাঁকা রাস্তা, ছোট-বড় পাহাড়-টিলা আর নজরকাড়া বাংলো। নগরবাসীর কাছে শহরের সিআরবির শিরীষতলার জায়গাটি চট্টগ্রামের ‘ফুসফুস’ হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, বড়সড় একটি হাসপাতাল নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করে সেই ‘ফুসফুস’ ধ্বংসের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

অবিভক্ত ভারতের বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম রেলওয়ের সদর দপ্তর সিআরবি ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে ১৮৯৫ সালে। শতবর্ষী বৃক্ষ, পাহাড়, টিলা ও উপত্যকায় ঘেরা এলাকাটি সব বয়সী সাধারণ মানুষের প্রাণ খুলে মুক্ত বাতাসে হাঁটাহাঁটি কিংবা ঘুরতে আসার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। আশপাশের পাহাড়ে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রাণীর আবাস। কয়েক বছর ধরে ডিসি হিলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় পয়লা বৈশাখসহ নানা আয়োজন হয় সিআরবি শিরীষতলায়। ছায়াঘেরা পরিবেশ নগরবাসীর প্রাতঃকাল ও বৈকালিক ভ্রমণ এবং বিনোদনের জন্য স্থানটি সর্বদা নগরবাসীর মন কেড়েছে।

বন্দরনগরীর সিআরবি মোড় থেকে টাইগার পাস, কদমতলী ও জিএম বাংলোমুখী সড়কগুলোর দুই পাশে রয়েছে শতবর্ষী রেইনট্রি ও বিভিন্ন প্রজাতির গাছগাছালি। সড়কের বাঁ পাশে রয়েছে রেলওয়ে হাসপাতাল (বর্তমান), পাশে খালি জমি, রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনি রোড এবং রাস্তাটির দুই পাশে থাকা প্রায় ৫০টি কর্মচারী কোয়ার্টার (একতলা সেমিপাকা) নিয়ে মোট ছয় একর জমিতে হাসপাতালটি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (সিসিইএ) সভায় গত ২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট ওই স্থানে হাসপাতাল প্রকল্পটি পিপিপিতে বাস্তবায়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। গত বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি পিপিপি প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয় সিসিইএ সভায়। এরপর গত বছরের ১৮ মার্চ চুক্তি সই হয়। চলতি বছরের শুরুতে নির্ধারিত জমির সামনে প্রকল্পের সাইনবোর্ড লাগানো হয়।

সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল তৈরির জন্য লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে সাইনবোর্ড
ছবি: প্রথম আলো

বন্দর নগরীর সিআরবি ভবনটি দেশের ব্রিটিশ বা কলোনিয়াল স্থাপত্যের বিলীয়মান নিদর্শনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপত্যকলা। পাশাপাশি এটি নগর–পরিকল্পনা, স্থাপত্য কিংবা ইতিহাসের শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা ও গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ২৪ ধারা অনুযায়ী, ঐতিহ্য ভবন ঘোষণা করে এলাকাটিকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে।

মহানগরী, বিভাগীয় শহর, জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০–এর বিধান অনুযায়ী, ‘খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাইবে না বা উক্ত রূপ জায়গা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা যাইবে না বা অনুরূপ ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করা যাইবে না। ব্যাখ্যা—এ ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে কোনো উদ্যানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয় এ রূপে উহার বৃক্ষরাজি নিধনকে উদ্যানটির শ্রেণি পরিবর্তনরূপে গণ্য করা হইবে।’

পাশাপাশি জাতীয় পরিবেশ নীতি ২০১৮–এর ৩.১৭ ধারায় আবাসন, গৃহায়ণ ও নগরায়ণে (Accomodation, Housing and Urbanization) স্পষ্টভাবে বলা আছে, সারা দেশে খেলার মাঠ, পার্ক, বাগান, নার্সারি, উন্মুক্ত স্থান ও ঐতিহ্যবাহী প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাসমূহ সংরক্ষণে গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ, দেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী চিন্তা করলেও দেখা যায়, কোনোভাবেই বন্দরনগরীর ফুসফুসখ্যাত সিআরবির প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং ঐতিহ্য ধ্বংস করে হাসপাতাল নির্মাণের কোনো সুযোগ নেই।

অন্যদিকে নগর–পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করলে দেখা যায়, ২০১২ সালে প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে সিআরবিকে সাজিয়ে বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রকল্প হাতে নিয়েছিল চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। রেলওয়ে সদর দপ্তর এবং এখানকার রেলওয়ে আবাসিক এলাকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রায় যাতে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রেখেই প্রকল্পটি তৈরি করা হয়েছিল। সিআরবির পুরো এলাকাকে প্রকল্পের আওতায় না এনে লোক চলাচলের জন্য উন্মুক্ত সাত রাস্তার মোড় ঘিরে ২৫ একর জমির ওপর প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল। পরিকল্পনার মধ্যে ছিল সিআরবির অভ্যন্তরে ছোট খালটিকে বাড়িয়ে কৃত্রিম লেক তৈরি, ফোয়ারা, কৃত্রিম ঝরনা, পাহাড়ে ওঠার জন্য সিঁড়ি নির্মাণ, এক পাহাড়ের সঙ্গে অন্য পাহাড়ের সংযোগ তৈরির জন্য পদচারী–সেতু, লেকের ওপর কাঠের পাটাতনে বসার জায়গা, হাঁটাচলার জন্য দুই কিলোমিটারের বেশি রাস্তার পাশে তাঁবুর আদলে বসার জায়গা সৃষ্টি করা। এ ছাড়া পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে আসা খাদে অ্যাম্ফিথিয়েটার নির্মাণ করে সেখানে একসঙ্গে চার হাজার মানুষ বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করার সুবিধা তৈরির কথা ছিল। ওয়াক ওয়ে, রুফ ওয়ে, লেক, ঝরনা, ফুড কর্নারসহ আরও কিছু নাগরিক সুবিধা রাখারও পরিকল্পনা ছিল।

মোদ্দাকথা হলো, চট্টগ্রামে ঢাকার মতো রমনা পার্ক কিংবা বোটানিক্যাল গার্ডেন নেই। গাছগাছালিতে আচ্ছাদিত নয়নাভিরাম এ উন্মুক্ত পরিসরও যদি না থাকে, নগরীর সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়! আমরা হাসপাতাল নির্মাণের বিপক্ষে নই। চট্টগ্রামে রেলওয়ের অনেক খালি জায়গা আছে, যেখানে হাসপাতাল করা যায়। কিন্তু যেকোনো মূল্যে সিআরবির প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে হবে।

লেখক: মো. শাহ জালাল মিশুক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক