ঘুমহীন একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠছে

ঘরবন্দী শিশুরা অবসাদ কমাতে টিভি-মোবাইলে সময় কাটাচ্ছে এখন। চট্টগ্রাম নগরে বসবাস করা সত্যি দাশ মোবাইলে ভিডিও দেখছে। চট্টগ্রাম নগরের রহমতগঞ্জ এলাকার ছবিটি সম্প্রতি তোলাছবি: সৌরভ দাশ

সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া নাবিদ মেধাবী শিক্ষার্থী। পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। মা–বাবার স্বপ্ন, নাবিদ একদিন মানুষের মতো মানুষ হয়ে দেশ, জাতি ও পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেবে। করোনাভাইরাসের শুরু থেকেই মা–বাবার কপালে চিন্তার ভাঁজ। একদিন মা–বাবা সন্তানকে নিয়ে সাক্ষাৎ করতে গেলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে। তাঁদের একটাই অভিযোগ—সন্তান সারা দিন মুঠোফোন ব্যবহার করে এবং বেশি রাতে ঘুমায়।

ওপরের কথাগুলো যদিও কাল্পনিক, তবে হাজার হাজার পরিবার তাদের সন্তানকে নিয়ে চিন্তিত মুঠোফোনের এমন অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে। করোনাভাইরাসের শুরু থেকে একযোগে শুরু হয়েছে অনলাইনভিত্তিক ক্লাস। মা–বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সন্তানকে মুঠোফোন দিতে হয়েছে। এ সুযোগে সন্তানেরা মুঠোফোনকে তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হিসেবে মেনে নিয়েছে। শিক্ষার্থীদের বৃহৎ একটা অংশ এখন মুঠোফোন ব্যবহার করে।
পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন গেমে আসক্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এসব গেমে দিন দিন এতই আগ্রহ পাচ্ছে যে পড়াশোনা, ঘুম, খাবার—সবকিছু বাদ রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুঠোফোন ব্যবহার করছে। শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, শিক্ষার্থীদের বৃহৎ একটা অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সব সাইটে নিয়মিত সক্রিয়।

কেউ কেউ ভিডিও, টিকটক ইত্যাদি করছে। ফলস্বরূপ যেটা হচ্ছে, তাদের মধ্যে মুঠোফোন ব্যবহার করার একটা ঝোঁক চলে আসছে। ইচ্ছা হলেও এখন আগের মতো মনোযোগসহকারে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে না মুঠোফোনের নেশায়। নিয়মিত গেমসসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় দিয়ে গভীর রাতে ঘুমাচ্ছে। এ কারণে দিন দিন তাদের স্মৃতিশক্তি লোপ পাচ্ছে। অভিভাবকদের মতে, তাঁদের সন্তানেরা এখন আর আগের মতো যথাসময়ে ঘুমায় না। অথচ সকালে ঠিকই ঘুম থেকে উঠে স্কুল–কলেজে যেতে হচ্ছে। যার ফলে তাদের মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করছে না। সব সময় চোখে ঘুম থাকে এবং মন-মেজাজ খিটখিটে থাকে।

মুঠোফোন
ছবি: রয়টার্স

মুঠোফোনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন অনৈতিক কার্যক্রমে। এমনকি অনেকে যুক্ত হচ্ছে কিশোর গ্যাংসহ নানা অপকর্মে। তাদের এ অপকর্মের পাল্লা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। এসব অপকর্মের জের ধরেই প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, যেগুলো গুম, খুন, হত্যা থেকে শুরু করে নানান ঘটনা। এমন একটা অবস্থায় বেড়ে উঠছে আগামীর বৃহৎ একটা প্রজন্ম। যেটা দেশ ও জাতির জন্য অনিরাপদ ও অপ্রত্যাশিত।

কিন্তু এর থেকে মুক্তি পেতে আমাদের সমাজ, পরিবার ও বিদ্যালয় তেমন কোনো ভূমিকা পালন করছে না। কিছু পরিবার যদিও সন্তানকে চাপ প্রয়োগ করে সঠিক পথে রাখার চেষ্টা করছে, তবে বৃহৎ একটা অংশ খুব বেশি তদারক করছে না। ফলস্বরূপ সন্তান দিন দিন বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে।

তবে এর জন্য এখনই পরিবার থেকে শুরু করে আমাদের সমাজের দায়িত্ব নিতে হবে। একজন শিক্ষার্থীকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করার আগে কোনোভাবেই সারা দিনের জন্য মুঠোফোন ব্যবহার করার সুযোগ দেওয়া যাবে না এবং যতক্ষণ ব্যবহার করবে, লক্ষ রাখতে হবে, তারা মুঠোফোন কোন কাজে ব্যবহার করছে এবং কাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে।

পাশাপাশি বিদ্যালয় ও সমাজ থেকে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মশালার আয়োজন করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা পরিবর্তন আসে। তারা যেন কোনো অপকর্মের সঙ্গে লিপ্ত না হয় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ভালো কাজে প্রয়োগ করে। এ ছাড়া স্কুল ও কলেজগুলোয় শিক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলতে বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে অনেক কিছু শেখা, জানা ও উদ্ভাবন করা সম্ভব—এমন বিষয় তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে।

লেখক: মো. সায়েদ আফ্রিদী, শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ