গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশে করোনার ঢেউ কি বাড়বে

করোনাভাইরাস
প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

কোভিড-১৯–এর ধরন প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং বিবর্তনের মাধ্যমে ছড়াচ্ছে সংক্রমণ, বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের নতুন ধরন অমিক্রন বর্তমানে বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এবং বাংলাদেশেও তা শনাক্ত হয়েছে অনেকের শরীরে। তাই ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত করতে বর্তমান প্রয়াসের সঙ্গে আমাদের ধারণা ও বাস্তবতার সেতুবন্ধ থাকা জরুরি। কারণ বাংলাদেশে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি জানুয়ারিতে মোট শনাক্তের সংখ্যা ছিল দুই লাখের বেশি। আর মৃত্যু ২৮৭, যা জানুয়ারির শুরুতে (১ জানুয়ারি ২০২২ তারিখ) ছিল ৩৭০ জন।

গত দুই বছরের উপাত্ত যদি দেখা হয়, সে ক্ষেত্রে ২০২০ সালে বাংলাদেশে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল জুন (৯৮ হাজার ৩৩০), জুলাইয় (৯২ হাজার ১৭৮) ও আগস্টে (৭৫ হাজার ৩৩৫)। বিপরীতে ২০২১ সালের জুলাই (৩ লাখ ৩৬ হাজার ২২৬), আগস্ট (২ লাখ ৫১ হাজার ১৩৪) এবং জুন (১ লাখ ১২ হাজার ৭১৮) মাসেও বেশি ছিল। উল্লেখিত মাসগুলোতে বাংলাদেশের আবহাওয়া সাধারণত গরম থাকে এবং সংক্রমণের গতি তুলনামূলক ঊর্ধ্বমুখী। আবার একই সময়ের মধ্যে ২০২০ সালের অক্টোবর (৪৪ হাজার ২০৫) ও ডিসেম্বর (৪৮ হাজার ৫৭৮) মাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিল, যা ২০২১ সালের নভেম্বর (৬ হাজার ৭৪৫) এবং ডিসেম্বর (৯ হাজার ২৫৫) মাসে ছিল নিম্নগামী।

তাই শীতকালের অথবা উষ্ণ মৌসুমের তাপমাত্রার সঙ্গে সংক্রমণের হারের সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, তা স্পষ্ট করে বলার জন্য তথ্যপ্রমাণ যথেষ্ট নয়। তাই প্রচলিত ধারণা ও বাস্তবতার রূপরেখা অনুযায়ী আগামীর পরিকল্পনা আরও সমৃদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।
কিন্তু ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব যেমন বাড়ছে এবং সেই সঙ্গে শীতকালীন রোগবালাইও বাড়ছে (যেমন সর্দি, হাঁচি-কাশি, গলা ব্যথা ইত্যাদি)। এই সময়ে শীতকালীন রোগবালাই মোকাবিলায় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে সাধারণ ফ্লু (Flu) থেকে কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণগুলোকে আলাদা করতে না পারা। তবে কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হোক বা শীতকালীন রোগবালাই হোক, তার প্রভাবে স্থবির হয়ে পড়ে মানুষের জীবন ও জীবিকা। বিশেষ করে যাঁরা দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল। এমনকি স্বল্প আয়ের বেতনভুক্ত মানুষেরও আয় বন্ধ হয়ে যায়। তখন ব্যয় কমানোর জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হয়। পরিবর্তন আনতে হয় তাঁদের খাদ্যতালিকায়, এমনকি শিশুর খাদ্যেও পরিবর্তন আনতে হয়। এই বাস্তবতার সঙ্গে কিছুটা খাপখাইয়ে নেওয়ার জন্য চালু হয়েছে বাসায় থেকে অফিসের কাজ করার প্রক্রিয়া। অনলাইনে ব্যবসাও অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু, স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে বা এ ধরনের কাজে দক্ষতা না থাকলে একই প্রক্রিয়ায় জীবিকায়ন নিশ্চিত করা কঠিন।

জীবন নির্বাহের জন্য যে প্রক্রিয়াই নেওয়া হোক না কেন, তার মধ্যে ২০২০ ও ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছিল অবরুদ্ধকরণের (লকডাউন) দিনগুলোতে। যার অনেকাংশেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল কৃষি খাত, শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা ও মানবিক সহায়তার বিভন্ন খাতে। অনেক জায়গায় কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত পণ্য অনেক কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অনেকেই তাঁর আপনজনের মৃত্যুর সময় তাঁর সংস্পর্শে যেতে পারেননি। আবার অন্যদিকে ব্যস্ত নগরীর কর্মব্যস্ত মানুষের এই থমকে যাওয়া দিনগুলোতে এসেছিল তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনা, ভালোবাসা-হতাশার মধ্যে বিরাট এক পরিবর্তন। তৈরি হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্পর্ক উন্নয়ন বা মেলবন্ধনের নতুন ক্ষেত্র। কিন্তু প্রযুক্তিনির্ভর নতুন বাস্তবতা ও সম্পর্ক কোনোভাবেই দূর করতে পারেনি উদ্বেগ ও মানসিক অবসাদ। অবরুদ্ধকরণ (লকডাউন) পদ্ধতির ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব যা–ই থাক, তা বাড়িয়ে তুলছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা।

গবেষণার ফলাফল বলছে, বাংলাদেশে গত দুই বছরে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির প্রভাবে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ও বৈষম্য আরও বেড়েছে। বর্তমানে এই প্রভাব কাটিয়ে উঠে অর্থনীতি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। নতুন রপ্তানি নীতিতে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৮০ বিলিয়ন ডলার। তবে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বৈষম্যের কারণে বা বিনিয়োগ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে প্রত্যাশিত হারে দেশে দারিদ্র্যের হার কমবে না। তাই মানবিক সহায়তা, উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরতে হলে প্রয়োজন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর এই রোগকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা জন্মানো। তার সঙ্গে নিশ্চিত হওয়া বিনা মূল্যে মাস্ক ও সবার টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা।

যদি বেঁচে থাকাকে উদ্বেগহীন করতে হয়, তবে এ পর্যন্ত মাস্কের ব্যবহারকেই অন্যতম কার্যকর উপায় বলে একমত হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সেই সঙ্গে প্রয়োজন টিকা গ্রহণের জন্য আরও উৎসাহিত করা এবং শতভাগ মানুষের টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা। কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত রোগীর হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুঝুঁকি কমিয়ে আনতে ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে এবং অনেক ওষুধ এখন বাংলাদেশেও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু রোগীর বয়স, শারীরিক সক্ষমতা ও উপসর্গ অনুযায়ী জটিলতা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে ওষুধ সেবনের আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ।

বাংলাদেশ সরকার টিকা গ্রহণের হার লক্ষ্যমাত্রায় নিয়ে যাওয়ার জন্য অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। তবে যেকোনো লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস এবং নাগরিক দায়িত্ব পালনে সচেতনতা। সেই সঙ্গে সব কার্যক্রমের স্বচ্ছ, গতিশীলতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া করোনাভাইরাসের প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন। আমরা আশাবাদী, টিকাদান ও চিকিৎসাসেবার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে, যার মাধ্যম ভবিষ্যতের সব উদ্বেগ দূর হবে। কোভিড-১৯ সংক্রমণরোধে সামাজিক দায়বদ্ধতার বিকল্প নেই।

লেখক: মনিরা পারভীন: মানবাধিকার পেশাজীবী ও উপদেষ্টা, কানেকটিং কমিউনিটি।
[email protected]