গারো পাহাড়ের পাদদেশে হাজংদের চেংগ্নী মেলায় এক দিন
প্রতিবছরের মতো এবারও দোলপূর্ণিমায় নেত্রকোণার কলমাকান্দার লেঙ্গরা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী চেংগ্নী গ্রামের গোপালবাড়িতে শত বছরের বেশি ঐতিহ্যবাহী চেংগ্নী মেলার আয়োজন করা হয়েছিল। করোনা মহামারিতে মেলা হবে কি না, এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল গোপালবাড়ি পূজা ও মেলা কমিটি। অবশেষে দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে মেলা বসে। হাজং সম্প্রদায়–অধ্যুষিত দোলপূজা উপলক্ষে এ মেলা বসে।
স্থানীয়ভাবে জনশ্রুতি আছে, ১৭৫ বছর ধরে সীমান্তবর্তী গোপালবাড়ি চেংগ্নী গ্রামে হাজং সম্প্রদায়ের পূজা মণ্ডপে দোলপূজা হয়ে আসছে। এ পূজাকে ঘিরে প্রতিবছর মেলার আয়োজন করা হয়। এ বছর মেলা গত বুধবার (২৪ মার্চ) শুরু হয়ে গত শুক্রবার (২৬ মার্চ) পর্যন্ত তিন দিনব্যাপী চলে। করোনা মহামারির কারণে মেলার সময়সীমা কমিয়ে আনা হয়। মেলায় নানা পণ্যসামগ্রী নিয়ে শতাধিক দোকান বসেছে।
মেলার উত্তর পাশে অবস্থিত পাহাড়ঘেঁষা গোপালবাড়ি মন্দির। বড়ই নয়নাভিরাম স্থান। এখানকার অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে দর্শনার্থীদের মন অকথিত আনন্দে নেচে ওঠে। গোপালবাড়ি মন্দিরটা বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন একটি উঁচু টিলার দক্ষিণের ঢালুর পাদমূল ঘেঁষে নির্মিত। এর নির্মাণশৈলী দেখলে মনে হবে মন্দিরটা যেন অলৌকিকভাবে টিলার দক্ষিণ-ঢালুর শেষ প্রান্ত ভেদ করে নিচে থেকে পাহাড়ের গা ঘেঁষে উত্থিত হয়েছে। মন্দিরের বহিরাঙ্গনে একটা বৈঠকঘরে দর্শনার্থীদের বসার ব্যবস্থা রয়েছে। এলাকার সব ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে পূজা ও মেলা সম্পন্ন করতে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে থাকে। দোল পূজায় পূজা মন্ডপে প্রতিদিনই বিভিন্ন কীর্তনিয়া দল কীর্তন পরিবেশন করে। দর্শনার্থী নারী-পুরুষের মধ্যে প্রতিদিনই প্রসাদ বিতরণ করা হয়। নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ মেলা উপভোগ করতে এখানে আসেন।
এ মেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে ভারতের সুবিশাল মেঘালয় পাহাড় ও এর নান্দনিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। মেলার আশপাশে বাংলাদেশে রয়েছে বেশ কিছু টিলা। অনেক দর্শনার্থী পাহাড়ী সৌন্দর্য অবলোকন করার জন্য অতি আগ্রহ নিয়ে মেলায় আসেন। দর্শনার্থীরা পাহাড়ি নির্জনতায় কিছুটা সময়ের জন্য হলেও প্রকৃতির মধ্যে মনের আনন্দে হারিয়ে যান।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী। কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’ কবিগুরু যথার্থই বলেছেন। উপলক্ষ যা–ই থাকুক না কেন, বাঙালির সব উৎসবের মধ্যে সর্বজনীন রূপ আছে। এতে ধর্ম, সম্প্রদায়, জাত-পাত বা ধনী-গরিবের সামাজিক বিভক্তি কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। বরং সব শ্রেণির মধ্যে সেতুবন্ধন হয়। আর এ কারণেই কালের বিবর্তনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকতার ধরন পাল্টালেও আবহমান বাংলার সামাজিক উৎসব, পার্বণ বা গণমানুষের মেলবন্ধনের ঐতিহ্য-কৃষ্টি আজও হারিয়ে যায়নি। চেংগ্নী ‘মেলা’ তেমনি প্রাচীন ঐতিহ্য। মানুষের উচ্ছ্বাস-উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এ মেলার মধ্য দিয়ে। ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠে মেলা মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলে। চেংগ্নী মেলা তাই শত বছরের ঐতিহ্যের এক মহাসম্মিলন।
চেংগ্নী মেলাকে সামনে রেখে চারু–কারু ও অন্যান্য কুটিরশিল্পীরা দীর্ঘ সময়ব্যাপী প্রস্তুতি নেন। কামার–কুমার ও বাঁশবেতের শিল্পীরা নিপুণ হাতে তৈরি করে নানা জিনিস মেলায় আনেন। শিশু থেকে বৃদ্ধ—সব বয়সের মানুষের আকর্ষণ থাকে মেলায়। মেলায় আসা অনেকে মেলা থেকেই সারা বছরের ঘরগেরস্তালির অনেক জিনিসপত্র কিনে নেয়। তাই মেলার দর্শকদের প্রস্তুতিও কম থাকে না। পাহাড়ের পাদদেশের মানুষদের অভাব-অনটন যা–ই থাকুক, মেলার জন্য সবারই ছোটখাটো বাজেট থাকে। মেলার আগে বড়রা শিশুদের নগদ টাকা বকশিশ দেয়। দূরদূরান্তের আত্মীয়স্বজনও মানি অর্ডারে বা লোকমারফত পাঠিয়ে দেয় টাকা।
বাহারি পণ্যের পসরা বসে চেংগ্নী মেলায়। শিশুদের আনন্দ-বিনোদনের জন্য মেলায় পাওয়া যায় মাটির পুতুল, পালকি, ঘোড়া, ষাঁড়, হরিণ, নানা রকমের ঘুড়ি, টমটম, লাটিম, গাড়ি, বল, বেলুন, বাঁশিসহ নানা রকমের খেলনা। বহুল প্রচলিত ‘আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনেছি...’ গানটি আজও মেলার সেই ঐতিহ্যকেই ধারণ করে আছে। গাঁয়ের কুলবধূ ও কিশোরীরা মেলা থেকে কিনে নেয় আলতা, স্নো, পাউডার, কাঁচের চুড়ি, নাকের নোলক, কানের দুল, চুলের ফিতা, খোঁপা, ক্লিপসহ নানা জিনিস। হিন্দু রমণীরা মেলা থেকে ফিরে একজন আরেকজনকে জলে ভাসা সাবান ও সিঁদুর উপহার দিয়ে শুভকামনা জানায়। এ ছাড়া গেরস্তালির জিনিসপত্র, যেমন দা, কাঁচি, কুড়াল, খুন্তি, রান্নাবান্নার সরঞ্জাম, পাখা, ঢাকি, চালনি, ছিপি, জলচৌকি, পিঁড়ি থেকে শুরু করে বৃদ্ধদের ছড়িও পাওয়া যায় মেলায়। থাকে রসনা তৃপ্তির জিনিসপত্রও। বিশেষ করে মেলায় কেনা জিলাপি, গজা, লবঙ্গ, রসগোল্লা, কদমা, তিলুয়া-বাতাসা, ওখরা, বিন্নি ধানের খই ও দই-চিড়ার স্বাদই আলাদা। কাপড়, মনিহারি, প্লাস্টিক পণ্য, পূজার জিনিসপত্র, ধর্মীয় পোস্টার, ছবি, বাঁশবেতের সামগ্রী, তামা-কাঁসা-পিতলের বাসনপত্র প্রভৃতির দোকানও বসেছে মেলায়।
দর্শকদের তাৎক্ষণিক মনোরঞ্জনের জন্যও রয়েছে নানা আয়োজন। নাগরদোলা, পুতুলনাচ, বাউলগান, বায়োস্কোপ, সঙ, পুণ্যস্থানে কীর্তন, পূজা প্রভৃতি আয়োজন দর্শকদের বাড়তি খোরাক জোগায়, মেলাকে পরিণত করে আনন্দসাগরে। হাজং সম্প্রদায় চেংগ্নী মেলাকে ধর্মীয় উৎসব বলেই মনে করে। প্রসঙ্গত কখনো কখনো মেলার নামে জুয়া-হাউজি-অশ্লীল নৃত্যসহ কিছু অপসাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও চলে। মূলত এর পেছনে থাকে অর্থলিপ্সা। মেলায় হাজারো মানুষের স্রোতকে পুঁজি করে একশ্রেণির লোক এ ধরনের বেআইনি উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার চেষ্টা করে। এতে মেলার পরিবেশ শ্রীহীন হয়।
তবে সর্বসাধারণ কখনো এ বিষয়গুলোকে মেলার আঙ্গিক হিসেবে মনে করে না। তারা মেলাকে ধর্মীয় উৎসব, লোকাচার, আনন্দ-বিনোদন বা বছরের বিশেষ দিন হিসেবেই মনে করে। চেংগ্নী মেলা যুগ যুগ ধরে মানুষের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি করে আসছে। নানা ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের মধ্যে রচনা করছে সেতুবন্ধন। গারো পাহাড়ের পাদদেশে চেংগ্নী মেলা বেঁচে থাকুক চিরদিন।
লেখক: মো. মাহাবুবুর রহমান, উদ্যোক্তা