গণিত অলিম্পিয়াডের পেছনের গল্প

১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম গণিত অলিম্পিয়াড সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত করেন বুয়েটের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ। দেশের খ্যাতিমান দুই অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও মোহাম্মদ কায়কোবাদের প্রচেষ্টায় ২০০১ সালে বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াডের হাতেখড়ি হয়। দৈনিক প্রথম আলোর বিজ্ঞানবিষয়ক আয়োজন ‘বিজ্ঞান প্রজন্ম’ পাতায় ‘নিউরনে অনুরণন’ নামে একটি বিভাগ যুক্ত হয়, যার মাধ্যমে বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াডের প্রাথমিক যাত্রা শুরু হয়।

২০০২ সালে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও রাজবাড়ীতে প্রথমবারের মতো আঞ্চলিক গণিত অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় পর্যায়ে গণিত অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াডের কিছু পর দেশবরেণ্য প্রকৌশলী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৪ সালে গণিত অলিম্পিয়াডকে আরও সম্প্রসারিত করতে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় ডাচ্–বাংলা ব্যাংক লিমিটেড। সেই থেকে গণিত অলিম্পিয়াডের অবিরাম পথচলা।

বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির আয়োজনে, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় ‘গণিত শেখো, স্বপ্ন দেখো’ স্লোগানকে সামনে রেখে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে গণিত অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতা। ২০২২ সালে গণিত অলিম্পিয়াডের দুই দশক পূর্ণ হচ্ছে। কাজের সুবাদে গণিত অলিম্পিয়াডকে কেন্দ্র করে রয়েছে অজস্র স্মৃতি। পরিপাটি ও অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় গণিত অলিম্পিয়াডের বাছাই পর্ব, আঞ্চলিক পর্ব ও জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতা।

কিন্তু এই আয়োজনের পেছনে যাঁরা থাকেন, তাঁরা জানেন, একটি গণিত অলিম্পিয়াডের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কত কাজ থাকে এবং কত কষ্ট করতে হয়। যাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও দিকনির্দেশনায় গণিত অলিম্পিয়াড এত সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হয়, তিনি হলেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান ও তাঁর অত্যন্ত দক্ষ একদল সহকর্মী।

২০১০ সালে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশের (ভাব) উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার দুই–তিন পর গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ ও শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ভাব বাংলাদেশের তৎকালীন কান্ট্রি ডিরেক্টর জসিম উজজামান বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাব বাংলাদেশের কর্মকর্তা আবুল কালাম মোহাম্মদ আজাদকে গণিত অলিম্পিয়াডের জন্য বিশেষভাবে দায়িত্ব দেন।

আমি সরাসরি গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত নই, তবে যাঁরা গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করেন, তাঁদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। শিক্ষার্থীদের গণিত অলিম্পিয়াডের বই সরবরাহ করা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, গণিত অলিম্পিয়াডে নিবন্ধন করানো, পরীক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া, পরীক্ষায় ভালো করলে তাঁদের অনুপ্রাণিত করতে পুরস্কার প্রদান করা প্রভৃতি কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি। দুই বছর ধরে গণিত অলিম্পিয়াড অনলাইনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর আগে অফলাইনে বিভিন্ন জোনে বাছাই পর্ব, আঞ্চলিক পর্ব এবং সবশেষে জাতীয় পর্যায় ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতো। সাধারণত গণিত অলিম্পিয়াডের বাছাই পর্ব ও আঞ্চলিক পর্ব শীতকালে অর্থাৎ ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয়।

আমার বিগত দিনের অভিজ্ঞতার আলোকে দুই–একটি ঘটনা শেয়ার করতে চাই। কথায় আছে ‘মাঘের শীত বাঘের গায়’। একবার রংপুর আঞ্চলিক গণিত অলিম্পিয়াডে প্রচণ্ড শীতে কম্বল গায়ে আবুল কালাম মোহাম্মদ আজাদ গাড়িতে করে গিয়ে শিক্ষার্থীদের গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণে সহযোগিতা করেন। এভাবে ভাব বাংলাদেশের কর্মকর্তা নীলফামারীর আবদুল কুদ্দুস সরকার ও কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর বিশ্বজিৎ বর্মনসহ প্রধান শিক্ষক আনিচুর রহমান, মোশারফ হোসেন, গোলাম রাব্বানী, বাবুল হোসেন, উত্তম কুমার রায়, রাজশাহীর বাঘার আবদুল হামিদ, চট্টগ্রামের রাউজানের নাসরিন আক্তারসহ আরও অনেক শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন।

ভাব বাংলাদেশের অন্য কর্মকর্তাদেরও গণিত অলিম্পিয়াডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয়। ২০১৪ সাল থেকে স্কুলের শিক্ষার্থীরা গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে আসছে। মাঘ মাসের কনকনে শীতের মধ্যে সুদূর সাতক্ষীরার শ্যামনগরের প্রত্যন্ত অঞ্চল তপোবন, কলবাড়ি নেকজানিয়া, নওয়াবেঁকী, ভেটখালী, চিংড়াখালী, রমজাননগর থেকে ভোর ৪টা-৬টা বাজে সুন্দরবন, কলবাড়ি, নওয়াবেঁকী হয়ে হায়াবাতপুর হয়ে শ্যামনগর এবং সবশেষে ভুরুলিয়া স্কুলকে খানপুর থেকে নিয়ে খুলনায় গিয়ে গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করানো কঠিন কাজ ছিল। আঞ্চলিক অলিম্পিয়াডে আগের দিন বাগেরহাটে গিয়ে রাতে হোটেলে থেকে পরের দিন সকালে গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করা শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও ভাব বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের জন্য এক অন্য রকম অনুভূতি ছিল। শ্যামনগর থেকে আবু আবদুল্লাহ আল আজাদ, ফজলুল হক, প্রধান শিক্ষক এস এম হাফিজুর রহমান, রামরঞ্জন বিশ্বাস, হযরত আলী, প্রশান্ত কুমার বৈদ্য, আবদুস সাত্তার, আজাহারুল ইসলাম ও শিক্ষক তাপস কুমার মিস্ত্রি, কিঙ্কর মণ্ডল, রণজিৎ বর্মন, কল্যাণ সুন্দর কয়ালসহ সবার আন্তরিক সহযোগিতায় কষ্ট হলেও আনন্দময় পরিবেশে আমাদের শিক্ষার্থীরা গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করেছেন।

গণিত অলিম্পিয়াড পরীক্ষার পর ফলাফলের জন্য শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষক ও আমরা বেশি উদ্‌গ্রীব থাকতাম—কেমন ফলাফল করে আমাদের শিক্ষার্থীরা! জুনিয়র ও সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে এ পর্যন্ত ভাব বাংলাদেশের ২,২৬২ শিক্ষার্থী গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করেছে। তার মধ্যে ৩৮০ শিক্ষার্থী প্রথম পর্ব থেকে দ্বিতীয় পর্বে উত্তীর্ণ হয়েছে। ২০২০ সালে সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে তিনজন শিক্ষার্থী জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেছে। ২০২১ সালে শ্যামনগর থেকে ৫ জন, কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী থেকে ৩ জন, নীলফামারী সদর ও যশোরের কেশবপুর থেকে ১ জন করে মোট ১০ জন শিক্ষার্থী জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছ। যেসব শিক্ষার্থী গণিত অলিম্পিয়াডের জন্য প্রস্তুতি নেয় এবং যারা বাছাই পর্ব বা আঞ্চলিক পর্ব বা জাতীয় পর্যায়ে গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে, তারা পাবলিক পরীক্ষায়ও ভালো ফল করছে। ২০২২ সালে ২০তম গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণকারী সব শিক্ষার্থীর জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।

লেখক: ডেপুটি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ও অফিসার ইন-চার্জ, ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশ (ভাব)

*নাগরিক সংবাদে লেখা ও ছবি পাঠানো ঠিকানা [email protected]