ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু

‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু
পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু  
এই যে হিয়া থরথর
কাঁপে আজি এমনতরো
এই বেদনা ক্ষমা করো
ক্ষমা করো প্রভু।’

ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ি আজকাল। দীর্ঘ দেড় বছর আমরা বন্দী এক জীবনের সঙ্গে লড়াই করে চলেছি। অর্থনৈতিক, মানসিক এমনকি শারীরিকভাবে যে দৈন্যের ভেতর দিয়ে পার করছি, প্রতিটি দিন তা অকল্পনীয়। মাঝে মাঝেই হাঁপিয়ে উঠি, মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি আর কত দিন? সত্যিই কি এ অন্ধকার ঘুচবে না? ভোরের আলো নরম সূর্যের হাসি হয়ে কি আমাদের দেহ–মনে ফেলবে না প্রশান্তির ছায়া। বড্ড অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছি দিন দিন। ফেসবুকে মিথ্যা হাসির ছবি, বন্ধুদের সঙ্গে হ্যাঁ ভালো আছি বলে প্রতারণা করতে আর ভালো লাগে না।

যেসব বন্ধুর কাছে একটা মুহূর্ত চেয়ে পাওয়া যেত না তাদের ব্যস্ততার কারণে, সেই সব বন্ধু আজ কর্মহীন-বেকার। হাজারো লাখো মানুষ ঘরহীন, কর্ম নেই তাদের। কী এক মানবেতর জীবন যাপন করছে তারা। রোজ এ প্রাণের শহর ঢাকা ছেড়ে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যাচ্ছে কত চেনা-অচেনা মুখ। ভেবেছিলাম অন্ধকার কাটবে বুঝি শিগগিরই; কিন্তু না, আবার ঘনিয়ে আসছে বৈশাখী দিনের কালো মেঘের মতো এক ঝোড়ো বিকেল। কারোর মনে শান্তি নেই, কেবলই এক বিষাদের ছায়া।

রোজ ঘুম ভেঙে মনে হয় এভাবে আর কত দিন। একঘেয়েমি জীবন। অফিস বাসা, আবার অফিস। এ যেন এক যন্ত্রের জীবন। হাসি, আড্ডা, গান, কবিতা, বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো, পারিবারিক কোলাহল এক নিমেষে সব হারিয়ে গেল ভয়াবহ কোভিডের হাতছানিতে। মানুষ আমরা সত্যি বড় নিরুপায়।

এই তো সেদিন বিখ্যাত পরিচালক জেমস ক্যামেরনের একটা সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। সাক্ষাৎকারের মাঝে দেখানো হচ্ছিল ‘টাইটানিক’ আর ‘অ্যাভাটর’ মুভির কিছু আঁতকে ওঠা দৃশ্য। তখন মনে হচ্ছিল মানুষ যদি এমন ছবি বানিয়ে দুনিয়া কাঁপাতে পারে, তবে কেন কোভিডের ওষুধ বানাতে পারবে না। একদিন নিশ্চয়ই পারবে। এমন ভাবনাতে কিছুটা ভারমুক্ত লাগছিল। হতাশা কেটে যাচ্ছিল অনেকখানি।

কেন ক্লান্তি ভর করেছে, সেখানে ফিরে যাই। রোজ রোজ একই জীবনধারা কার ভালো লাগে বলুন। যে জীবনে আনন্দ নয়, হাসি নয়, কেবলই না পাওয়া আর হতাশার রূপরেখা চারপাশজুড়ে। সে জীবণ কি ভালো লাগে? কিন্তু আজ সকালে অফিস আসার সময় মনটা খুব ভালো হয়ে গেল। এক ছোট্ট জীবনের বড় সুখ দেখে। নিজেকে বোঝালাম এভাবেও ভালো থাকা যায় সুখী হওয়া যায় আর তার জন্য পাশে লাগে একজন নিরবচ্ছিন্ন বন্ধু সতীর্থ জীবনসঙ্গী। যারা কোনো ছলনা বোঝে না, নেয় না মিথ্যার আশ্রয়, করে না প্রহসন।

কুমিল্লা থেকে আশা রহিমা আর ফিরোজ মিয়া রাস্তার পাশে বসে পলিথিনকেই খাবারের প্লেট বানিয়ে সারছিলেন সকালের নাশতা। ওদের দেখে থমকে দাঁড়ালাম। একটুখানি গল্পও হলো। দীর্ঘ ২৮ বছরের দাম্পত্য জীবন তাঁদের। ঘরে তিন ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ের জামাই সিটি করপোরেশনে কাজ করেন। বেশ ভালোই আছেন মেয়ে। বড় ছেলেও বিয়ে করে সংসার করছেন।
ছেলে আর বউমা কি আলাদা থাকে?

রহিমা বললেন, ‘না আমাগো সঙ্গেই থাকে। আমরা সবাই এক লগে থাকি।’
ছেলে কাজ করে, ভাত দেয়?

ফিরোজ মিয়া বললেন, ‘হ্যাঁ, কাজ করে। ভাত–কাপড়ও দেয়।’
তাহলে এই বৃদ্ধ বয়সে কাজ করছেন কেন?

রহিমা বেশ ঝলমলে মুখে হাসি দিয়ে বললেন, ‘আপা ছেলের একার রোজগারে এতগুলো মানুষ বোঝ হয়ে যায়। তাই সবাই মিলেমিশেই কাজ করি। কোনো অসুবিধা হয় না।’

বাহ! দারুণ তো।

ফিরোজ মিয়া কলাবাগান একটা সুপারমার্কেটে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। ভোর পাঁচটায় কাজে আসেন আর বাসায় ফেরেন বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যায়।
রহিমা, আপনিও কি কাজ করেন?

‘হ্যাঁ, আমি দুপুর ১২টা পর্যন্ত থাকি। তারপর বাসায় গিয়ে রান্নাবান্না করি।’
এত বছরের সংসার, আপনাদের ঝগড়াঝাটি–মনোমালিন্য হয় কি?
দুজনেই একসঙ্গে হেসে দিলেন। ‘না আমাগো তেমন ঝগড়াঝাটি লাগে না।’
ওদের নিষ্পাপ চোখের হাসিই বলে দিল সুখ কিনতে টাকা লাগে না। লাগে প্রেম মায়া–মমতা আর একে অপরের প্রতি আস্থা–বিশ্বাস। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললাম,
রোজ সকালে ডাল আর পরোটা খান?

‘না, কোনো দিন কলা–পাউরুটি খাই আবার ভাতও নিয়া আসি।’
আর দুই ছেলে কী করে?

একজন দর্জির কাজ শিখছে আরেকজন ছোট।

ফিরোজ মিয়া, আপনার তো বেশ নাজুক শরীর, কাজ করতে ক্লান্তি লাগে না? মনে হয় না, ঘরে শুয়ে–বসে আরাম আয়েশ করি?

‘না গো আপা, মরার আগপর্যন্ত কাজ করতে চাই। কারও ওপর বোঝা অইতে চাই না।’
একটা হালকা বাতাস আমাকে ছুঁয়ে গেল আর কানে কানে বলে গেল, সময় কখনো শেষ হয়ে যায় না। তুমি যখন শুরু করবে, সেটাই সময়। বয়স ক্লান্তি এসব ভীষণ ব্যর্থ মানুষের কথা। সব ছেলেমেয়ে মা–বাবার দায়িত্ব নিক। মিলেমিশে একসঙ্গে থাক। কেউ কারও বোঝা না হোক। মানুষ আমরা হয়ে উঠি মানবিক।

সময়টা খারাপ, সে আমরা সবাই জানি। সারা পৃথিবী আজ ক্লান্ত। সে ক্লান্তি কখনো শরীরের কখনো বা মনের। তাই বলে থেমে গেলে তো চলবে না। হাঁটতে হবে, এখনো অনেকটা পথ।

তাই বলি,
‘এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু,
পিছন-পানে তাকাই যদি কভু।’
* লেখক: রোজিনা রাখী, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ