দ্বিতীয়বার কোভিডে আক্রান্ত চিকিৎসক ফারিয়ার অভিজ্ঞতা

হাসপাতালে ডা. ফারিয়া তাবাসসুম তন্বী
ছবি: সংগৃহীত

প্রথমবার ঈদের ছুটিতে ঘরে থাকার সময়ে কোভিড আক্রান্ত হই। পরিবারের আর কারও হয়নি। কোভিডের পুরো সময়টুকু ১৪ দিন অনলাইনে চিকিৎসা দিয়েছিলাম।

নিজের কোভিডের চিকিৎসাও চলছিল। সুস্থ হওয়ার পর খুব ক্লান্ত লাগত। খেতে পারতাম না অনেক দিন। ক্লান্ত লাগত। কিন্তু আমি নিজেকে সব সময় কাজে ব্যস্ত রাখি। এতে করে আবার অল্প সময়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসি। কোভিডের প্রথমবার ঘরে থেকেই সুস্থ হই।

কিছুদিন পর আবাসিক ডেন্টাল সার্জন হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) রোগী দেখা শুরু করলাম। এমএস ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলাম। সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ওপর সার্ভে করে থিসিস শেষ করলাম। ভালোই চলছিল সবকিছু। কিন্তু আবার প্রায় ৬ মাস পর (নভেম্বরে) কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হই।

প্রথমবার করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর আবার চিকিৎসায় লেখক
ছবি: সংগৃহীত

কয়েক দিন ধরেই  ক্লান্ত লাগছিল। হঠাৎ করেই ভীষণ জ্বর এল। অক্সিজেন সেচুরেশন মাপতেই দেখি ৯২, যেখানে ৯৭ থাকতে হয়। আসলে অক্সিজেন সেচুরেশনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোভিডে মৃত্যু বাড়ছে। কিন্তু আমরা ভাবছি নিশ্বাসে কষ্ট হলে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে, এটা ঠিক নয়। রক্তে অক্সিজেনের সেচুরেশন কোনো কিছু না বুঝতেই কমে যাচ্ছে। লক্ষণ ছাড়া কোভিড দিয়ে যেকোনো সময়ে আমরা আক্রান্ত হচ্ছি, যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বর্তমানে। যেটা আমার বেলায়ও ব্যতিক্রম হয়নি।

স্বামী সিলেটে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত। সেচুরেশন কমার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকা এসে আমাকে বিএসএমএমইউতে ভর্তি করিয়ে দেন। কেননা এক এক সেকেন্ড অত্যন্ত মূল্যবান। অক্সিজেন সেচুরেশন ৯০-এর নিচে চলে গেলে সুস্থ হওয়াটা খুব কঠিন হয়ে যায়।

হাসপাতালের ১২ দিন খুব কাছ থেকে অনেক মৃত্যু দেখেছি। অক্সিজেন সেচুরেশন ৬৫ নিয়ে এসেছিলেন আমার পাশের বেডের ডাক্তার আপা। তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়, তিনি মারা যান কয়েক দিন পর।

ডা. ফারিয়া মেয়েকে খুশি করার জন্য বিয়ের ১২ বছর পালন করছেন কোভিড নেগেটিভ হওয়ার ২ দিন পর
ছবি: সংগৃহীত

কোভিড-১৯ নিউমোনিয়া করে দেয়, রক্ত জমাট করে দেয়। তাই শুধু ঘরে বসে অক্সিজেন নিলেই পুরোপুরি চিকিৎসা হবে না। অক্সিজেন সেচুরেশন ৯৪-৯৫ থাকলে হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে। অন্যথায় জীবনের ঝুঁকি আছে।

আমি ১২ দিন হাসপাতালে থেকে জীবন-মৃত্যুর কত কিছু দেখে এলাম। কী যে কষ্ট হয়েছে, বলে বোঝানো যাবে না। তবে হাসপাতালে বসে একটা চিন্তা রাখতে হবে যে আমি বাড়ি ফিরব। আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি, এমন চিন্তা করাই যাবে না। নিশ্বাসের ব্যায়াম করতে হবে। অসুস্থতা যার যার, যুদ্ধটাও তার তার। অন্যের শরীর কীভাবে সুস্থ হচ্ছে, সেটা দেখে লাভ নেই। যার যার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা, মনোবল তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসবে ভাগ্য সহায় হলে। আমি একদম মনোবল হারাইনি।

আমার পাশের বেডের আরেক ডাক্তার আপা সিজারের সময় কোভিডে আক্রান্ত হন। তাঁর নবজাতককে বাসায় রেখে উনি হাসপাতালে সেচুরেশন খুব কম নিয়ে ভর্তি হন। ওনার সঙ্গে ৮ দিন পাশাপাশি বেডে থাকলাম। রাতে আপার গ্লুকোজ কমে যেত।

সিলেটে গবেষণার কাজে মেয়েকে নিয়েছিলেন ডা. ফারিয়া
ছবি: সংগৃহীত

আমি পাশে থেকে আপার যতটুকু পেরেছি, যত্ন নিয়েছি, সাহস দিয়েছি। আপার ৩টা বাচ্চা বাসায়, তার মধ্যে নবজাতককে বুকের দুধ দিতে পারছিলেন না। কয়েক দিনের মধ্যে আপার স্বামীও করোনা পজিটিভ হয়ে গেলেন। আপার নিশ্বাসের কষ্ট আমি দেখেছি। মা-বাবা দুজন কোভিডে আক্রান্ত, ঘরে তিনটা ছোট বাচ্চা। আপা এখন সুস্থ আছেন আগের থেকে। ওনাকে প্লাজমা সংগ্রহ করতে হয়েছে এক রাতে ২ ব্যাগ। এই সময়ে প্লাজমা দিয়ে জীবন বাঁচানো খুব গুরুত্বপূর্ণ। কত জায়গায় প্লাজমা খুঁজলাম, পেলাম না। আপার স্বামী তখন নিজেই পজিটিভ হয়ে গেছেন। উনি প্লাজমা ম্যানেজ করলেন।

আমার যেদিন নেগেটিভ এল, সারা রাত ঘুমাইনি ডাক্তার আপার জন্য। ওনার গ্লুকোজ কমে যাচ্ছিল। ওনাকে সুস্থ দেখেই বাসায় যাব। একা একা কি বেঁচে থাকার আনন্দ পাওয়া যায়? আল্লাহ আমাকে কোভিড রোগীর সেবা করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন, হাসপাতালের বেডে থেকে এর চেয়ে আমার বড় ভাগ্য কী হতে পারে।
এ সময় মানসিক প্রেশার নিলে আরও অসুস্থতা বাড়ে। ফিরে এসে নিয়মিত হাঁটছি, নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছি, হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করছি, কোভিডকে জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিয়ে আগামী সুন্দর দিনের অপেক্ষা করছি। এই দিন একদমই থাকবে না।

আসলে এখন কিছু সহজ নিয়ম সবাইকে মেনে চলতে হবে—

*দিনে ২ বার অক্সিজেন সেচুরেশন সুস্থ ও অসুস্থ সবাইকে মাপতে হবে পালস অক্সিমিটার দিয়ে। অক্সিজেন সেচুরেশন যদি ৯৫-এর নিচে নেমে যায়, আর কোভিডের কিছু লক্ষণ থাকে, অবশ্যই ডাক্তার দেখাতে হবে। এক পরিবারের সবাই অসুস্থ হয়ে গেলে, সমানভাবেই সতর্ক হতে হবে, ১৪ দিনে কার অসুস্থতা বেড়ে যাবে কেউ বলতে পারে না। নিশ্বাসের কষ্ট হতে হতে এর মধ্যেই ফুসফুস এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়, আর রোগী জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারে না। তাই অক্সিজেন সেচুরেশন মাপুন প্রতিদিন নিয়ম করে, সুস্থ আর অসুস্থ পরিবারের সবাই।

*কোনো মতেই ঠান্ডা খাবার খাওয়া যাবে না। তাহলে কোনটা কোভিডের জন্য ঠান্ডা, তা আলাদা করা যাবে না।

*খাবারে হালকা গরম পানি পান করা অভ্যাস করতেই হবে। পূর্বের সব অসুস্থতা নিয়ন্ত্রণে রাখুন। যেমন: ডায়াবেটিস, থাইরয়েডসহ অন্যান্য সব অসুখ। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে হেঁটে, ব্যায়াম করে, হাসিখুশি থাকা চাই।

*মাস্ক পরতে হবে। যেহেতু সংক্রমণ হার বেড়েছে।

*কোভিড যেকোনো সময় মৃত্যু নিয়ে আসতে পারে। অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। পাশের বন্ধুটিকে ভাবা যাবে না, যে তার কোভিড হয়নি। সর্বোচ্চ সতর্কতা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে প্লাজমা দিয়ে জীবন বাঁচাতে হবে।
এই দিন শেষ হবে। সুন্দর সুস্থ ভোরের অপেক্ষায় থাকলাম। নিজের যত্ন নিন।


*ডা. ফারিয়া তাবাসসুম তন্বী, আবাসিক ডেন্টাল সার্জন, বিএসএমএমইউ