কৃষকের ভাগ্য বিক্রি হচ্ছে আড়াই টাকায়
হতদরিদ্র কৃষক আতাবুদ্দিনের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বাকতা ইউনিয়ের কালনাজানি গ্রামে। সারা বছরই অন্যের জমিতে মজুর খাটেন। পরিবারের ১০ জন সদস্যের আহারের খরচ বহন করতে হয় আতাবুদ্দিনকে। তাই দিনমজুরের কাজের পাশাপাশি সংসারে একটু বাড়তি আয়ের কথা চিন্তা করে সবজি চাষাবাদে নিজের ভাগ্য বদলের আশায় বুক বাঁধেন তিনি। একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে লোন করে ৮ কাঠা জমি খোরাকি (এক মৌসুম চাষাবাদের জন্য জমি নেওয়া) নেন, তারপর সেই জমিতে মৌসুমি লাল তীর জাতের লম্বা বেগুনের আবাদ করেন। চাষাবাদে তাঁর খরচ প্রায় ৫০ হাজার টাকা। তবে এ মৌসুমে তাঁর খেতের বেগুন বিক্রি করতে পেরেছেন মাত্র ৫ হাজার টাকার। গতকাল মঙ্গলবার সকালে স্থানীয় কালাদহ সবজির বাজারে তিনি আড়াই টাকা কেজিদরে তাঁর জমি থেকে ৫ মণ বেগুন বিক্রি করেন, যার মূল্য দাঁড়ায় ৫০০ টাকা।
শুধু আতাবুদ্দিন নন, একই গ্রামের আরেকজন সবজিচাষি আবদুল মোতালেব তাঁর ২ একর জমিতে বেগুন আবাদ করেন। খরচ হয় প্রায় ১ লাখ টাকা। এ পর্যন্ত বিক্রি দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার টাকা। মঙ্গলবার উপজেলার সবচেয়ে বড় কাঁচাবাজার কালাদহ বাজারের হাটে মোতালেব বেগুন বিক্রি করেন ১০০ টাকা মণদরে ৮ মণ ৮০০ টাকা।
অথচ তাঁর দুই একর জমির জন্য সার এবং কীটনাশকই মঙ্গলবার কিনতে হয় ১০ হাজার টাকার। সার–কীটনাশকের পুরো টাকাই স্থানীয় দোকানদারের কাছ থেকে বাকিতে নিয়েছেন বলে জানান মোতালেব। উপজেলার কালাদহ বাজারে সপ্তাহের তিনটি হাট চালু রয়েছে, এই ৩টি হাটবারে সবজি বিক্রি হয় অন্তত ৩০ লাখ টাকার।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার সবজিচাষিরা এ বছর জমিতে উচ্চফলনশীল জাতের বেগুনের চারা রোপণ, পরিচর্যা থেকে শুরু করে ফলন আসার আগপর্যন্ত হাজারো টাকা ব্যয় করেন। দেশব্যাপী করোনাভাইরাসের বিরূপ প্রভাবে এবং থেমে থেমে বিধিনিষেধের জাঁতাকলে এবার বেগুনচাষিরা তাঁদের আবাদকৃত বেগুন পাইকারি হাটে বিক্রি করছেন মাত্র ২ টাকা ৫০ পয়সা বা আড়াই টাকা কেজিদরে। যে কৃষক বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে নিজের ভাগ্যকে রোপণ করেছিলেন দিনবদলের আশায়, আজ সেই মেহনতি কৃষকের ভাগ্যের ফলন হাটে মাত্র আড়াই টাকা কেজিদরে বিক্রি করতে হচ্ছে।
ফুলবাড়িয়ার অধিকাংশ সবজিচাষি কঠোর বিধিনিষেধের কবলে পড়ে সবজি বিক্রি করছেন পানির দামে। উপজেলার মৌসুমি সবজিচাষিরা বেসরকারি সংস্থা থেকে চড়া সুদে ঋণের টাকায় সবজি উৎপাদন করে এখন চরম বিপাকে। এভাবে বাজারদর চলতে থাকলে আসছে মৌসুমে বেগুনের মতো সবজি চাষ আদৌ করবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চিত চাষিরা।
খোঁজ করে জানা যায়, ফুলবাড়িয়া উপজেলার বেগুন আবাদ কারা সব চাষির একই অবস্থা। করোনার প্রভাবে বিধিনিষেধ থাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকার না আসা এবং পর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থাসহ বাজারে ক্রেতাসমাগম কমে যাওয়ায় সবজির ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষক। সময়মতো বিক্রি করতে না পারায় সবজি নষ্ট হচ্ছে এখন খেতেই। তাই সর্বস্বান্ত আতাবুদ্দিন, মোতালেবের মতো এমন কৃষকের স্বপ্নের ফসল পাইকারি হাটে বিক্রি হচ্ছে আড়াই টাকা কেজিদরে।
এ বিষয়ে বাকতা ইউনিয়নের কালনাজানি গ্রামের বেগুনচাষি আতাবুদ্দিন, মোতালেব, লোকমান, হাফিজ, মালেক মিয়া বলেন, ‘গত বছর সবজির আবাদ করেও মাইর খেলাম, এবারও বেগুন চাষ কইয়া পানির দরে বেগুন বিক্রি করতে হইতাছে। বিধিনিষেধের কারণে গাড়ি যায় না, পাইকারও আসেন না। আমগর কাছ থেইকা ২ টেকার বেশি বা আড়াই টাকার ওপরে দাম দিতে চায় না। এই দামে বেগুন বিক্রি করতে হইলে আমরা নিঃস্ব হয়া যামু। পথের ফকির হয়ে যামুগা, তাই দ্রুত বিধিনিষেধ তুলে দিলে আমরা অন্তত সবজির ন্যায্যমূল্য পাইতাম, কৃষকেরা বাঁচতাম।’
সরেজমিন উপজেলার রাঙামাটিয়া ইউনিয়নের পাহাড় অনন্তপুর, এনায়েতপুর ইউনিয়নের গোপীনাথপুর, ফুলতলা, বাক্তা ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর, শ্রীপুর, কালাদহ ইউনিয়ন এবং পুঁটিজানা ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, মৌসুমি সবজি, যেমন কলা, বেগুন, টমেটো, শসা, লাউ–কুমড়া, লেবুসহ নানা ধরনের সবজি নষ্ট হচ্ছে খেতে। বিভিন্ন স্থানীয় বাজারে বিধিনিষেধ থাকায় কৃষক তাঁর পণ্য নিতে পারছেন না, পাশাপাশি বাজারে পাইকার না থাকায় ন্যায্যমূল্যও পাচ্ছেন না চাষিরা। বিভিন্ন সরকারি সংস্থাও থেকে ঋণ করে সবজি চাষ করে বিক্রি করতে না পারায় চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা।
উপজেলার রাঙামাটিয়া এবং এনায়েতপুর ইউনিয়নে অন্তত ১ হাজার ৫০ একর জমিতে সবজির চাষ হয়েছে, যার নায্য বাজারমূল্য না থাকায় কোটি টাকার বেশি লোকসানের মুখে পড়েছেন সবজিচাষিরা।
রাঙামাটিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামের সবজিচাষি রহিমা খাতুন, সেলিম হোসেন, মাহমুদ আলী এবং রফিক, বকুল এনায়েতপুর ইউনিয়নের গোপীনাথপুর গ্রামের কাজিম উদ্দিন, মোস্তাক মিয়া, জয়নাল, হায়দার আলী বলেন, রাঙামাটিয়া আর পাহাড় অনন্তপুর এবং এনায়েতপুরের গোপীনাথপুর ও ফুলতলায় উপজেলায় সবচেয়ে বেশি সবজি উৎপাদিত হয়। এখানকার সবজি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকারেরা কিনে নিয়ে যান। এবার করোনাভাইরাসের কারণে এবং স্থানীয় কিছু পাইকারের সিন্ডিকেটের কারণে কৃষকেরা সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন বলে অভিযোগ তাঁদের। তাঁরা বলেন, বাজারে নিলে বেগুন দুই–আড়াই টাকা কেজি। এমনও হয়েছে, সবজি বাজারে বিক্রি করতে না পেরে ফেলে চলে যাচ্ছেন। সবজি পচে যাচ্ছে খেতে, অন্যদিকে মৌসুমও শেষ। তাই সামনের মৌসুমে নতুন সবজি চাষের টাকাও তাঁদের হাতে নেই। সরকার ঋণসহায়তা ও প্রণোদনা না দিলে সবজির আবাদ করা সম্ভব নয়।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলাটির মৌসুমি সবজি উৎপাদনের জন্য দেশব্যাপী সুনাম রয়েছে। বিশেষ করে আলু, হলুদ, রসুন, কলা, শিম, বরবটি, করলা, বেগুন, লাউ, কুমড়াসহ বিভিন্ন প্রকারের সবজির চাষ হয় এ জনপদে। প্রতি সপ্তাহে উপজেলার কালাদহ, বাকতা, গোপীনাথপুর, বাবুগঞ্জ, এনায়েতপুর ও ফুলবাড়িয়ায় সবজির বড় হাট বসে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন জেলার পাইকারেরা আসেন সবজি কিনতে।
এখন করোনার প্রভাবে কঠোর বিধিনিষেধ থাকায় পাইকাররা আসছেন না, স্থানীয় পাইকাররাও সবজি কিনছেন না। এর মধ্যে আবার স্থানীয় পাইকারদের সিন্ডিকেট করার অভিযোগও করছেন কৃষকেরা।
উপজেলার রাঙামাটিয়া ইউনিয়নের পাহাড় অনন্তপুরের সবজিচাষিদের ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সালিনা চৌধুরী বলেন, রাঙামাটিয়া ইউনিয়নের একটি বড় অংশের মানুষ সবজি চাষের ওপর জীবিকা নির্বাহ করে। বিশেষ করে পাহাড় অনন্তপুরে প্রচুর মৌসুমি সবজির আবাদ হয়। এবার করোনার প্রভাবে চাষিরা খুবই বিপর্যয়ের মধ্যে আছেন। তাঁরা বাজারে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। সব প্রান্তিক সবজিচাষিকে সরকারিভাবে প্রণোদনার আওতায় আনা এবং সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
উপজেলার এনায়েতপুর ইউনিয়নে লেবুর জন্য জনপ্রিয়। ফুলতলা গ্রামের লেবুচাষিরা শুরুত লেবুর দাম নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলেও স্থানীয় কিছু সিন্ডিকেটের কারণে দাম ইতিমধ্যে কমতে শুরু করেছে বলে জানান ফুলতলার লেবুচাষি নুরুল ইসলাম মাস্টার।
ফুলবাড়িয়া উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, এবার উপজেলায় ১ হাজার ৮৯৫ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে শুধু সবজি। এর মধ্যে বেগুন চাষ হয়েছে ২৩০ হেক্টর জমিতে।
এ বিষয়ে ফুলবাড়িয়া কৃষি কর্মকর্তা জেসমিন নাহার বলেন, ‘বেগুন মূলত একটি ব্যয়বহুল সবজি। ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজিতে বেগুন বিক্রি করতে না পারলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষকেরা। সরকারের তরফ থেকে আমরা সবজিচাষিদের ব্যাপারে গাইডলাইন পাইনি, কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের প্রণোদনার বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা পাইনি। তবে ফুলবাড়িয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত সবজিচাষিদের অবস্থা খুবই খারাপ। আশঙ্কার বিষয় হলো, কৃষকেরা সবজি চাষাবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে দেশে খাদ্যঘাটতিসহ পুষ্টিহীনতার একটা বড় সংকট দেখা দিতে পারে।’
জেসমিন নাহার আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমরা অসহায়, গরিব ও দুস্থদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের ক্ষেত্রে শুধু চাল, ডাল আলু ইত্যাদি দিতে দেখছি। বর্তমানে ত্রাণসামগ্রীর সঙ্গে যদি কৃষকদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিতরণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তাহলে কৃষকেরা অন্তত তাঁর পণ্যের ন্যায্যমূল্য পেতে পারেন।’
বিশ্ব করোনায় বিপর্যন্ত। প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশও। সবকিছু বন্ধ থাকায় পণ্যের দাম না পাওয়ায় গ্রামের প্রান্তিক চাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দ্রুত সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত সবজিচাষিদের তালিকা করে তাঁদের প্রণোদনা এবং সুদমুক্ত ঋণের মাধ্যমে সবজি চাষে আবারও উদ্বুদ্ধ করে তোলা দরকার।