আরও একটা ঈদ এল, বাড়ি না যাওয়ার। আম্মার মন খারাপ হলো এবং আমাদেরও। সবশেষ বাড়ি গিয়েছি ফেব্রুয়ারি মাসে, পাঁচ মাস আগে। সুনামগঞ্জ ছোট্ট শহরে। তিন দিন ছিলাম। আসার সময় আম্মার জিজ্ঞাসা, আবার কবে বাড়ি ফিরব? করোনার জন্য বাড়ি যাওয়া না–যাওয়ার বিষয় আটকে গেছে অফিশিয়াল বিধিনিষেধের জালে। যত দিন যাচ্ছে, ব্যস্ততা বাড়ছে হু হু করে। এখন যদিও সময় পেলে আম্মার বাড়িতে যাই, শহরের ছোট্ট সে ঘরে; কিন্তু পাশ ফিরে আর দেখা হয় না আমার গ্রাম, হাওরপাড়ের আবিদনগর, যেখানে আমি জন্মেছিলাম।
এক বালকের মাটির সঙ্গে পা ফেলে বড় হওয়ার সেসব দিন; আর ফিরবে না কভু, জানি। ঈদে সব ভাইবোন একসঙ্গে গোল হয়ে বসতাম আমাদের ছোট্ট সেই রান্নাঘরে। আহা, মায়ের হাতের রান্না! এখনো আম্মার সামনে গেলে এটা-সেটা খাওয়াতে চেষ্টা করেন। বয়েস হয়েছে; আম্মাকে আমিই ‘না’ করি। আর গ্রামে যাই না যুগ পেরোচ্ছে প্রায়। তবে মগজে জিওল মাছের মতো ঘাই মারে সেই রান্নাঘর। আমি জানি, পাকঘরের পেছনের পেঁপেগাছের সারি আর সেই ঈদগুলো জনমের মতো হারিয়েছি।
করোনাকালে প্রথম ঈদ হলো গত বছর। ঢাকায় ঈদে তেমন কোথাও যাই না। যাওয়ার জায়গা নেই তা নয়; ইচ্ছা করে না। টানা কাজের পরে ক্লান্ত হয়ে জিরোনোর মতো, ঈদের ছুটিতে আমি চুপচাপ থাকি। ঈদের আগে আগে কুরিয়ারে উপহারের প্যাকেট আসে, বই কিংবা পাঞ্জাবি; অনেক প্যাকেট। কোনোটা খুলিই না, রেখে দিই। ঈদের দিন হয়তো দু-একজন বন্ধু আসে, অফিসের কলিগ কিংবা লেখক-পাঠকদের মধ্যে কেউ কেউ আসে। আমি কথা কম বলি, কাছের জনেরা তা জানেন। আড্ডায় আমি শ্রেষ্ঠ শ্রোতা। ঈদের উজ্জ্বল দুপুরেও তারা কথা বলে বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে। আমি শুনতে থাকি। আমার হাতে থাকা ‘সক্রেটিসের শেষ দিনগুলো’ বইয়ের পাতা উল্টাই। আমার স্ত্রী রুনা চা করে আনেন। আমার ছেলে দ্বিতীয় এদের কারও না কারও কাঁধে ঝুলে দুষ্টুমি করে, আমি তাকে সামলাতে চেষ্টা করি। আলাপ জমে ওঠে করোনার তাণ্ডবে আর কার চাকরি গেল, কার অফিস বেতন কমিয়েছে, বন্ধুদের কারও ব্যবসা বন্ধ, একজন তার সন্তানের মতো স্নেহের প্রেসখানা বিক্রি করে কতক্ষণ কেঁদেছে, এসব নিয়ে। আমি কোনো কথা বলি না। কেবল ভাবি, ঈদের এই দুপুরের সঙ্গে ফেলে আসা ঈদ মেলে না। একেবারেই না!
এর মানে আমি সুখে নেই, তা কিন্তু নয়। অসহ্য রকমের সুখ আমি যাপন করে চলেছি। সবচেয়ে বড় কথা, আমার যখন যা খুশি আমি পড়তে পারি, লিখতে পারি। সারাক্ষণ দেখি, দ্বিতীয় এটা–ওটা এঁকে ফেলে, আমাকে দেখায়। আমার চারদিকে ঘুরঘুর করে। আমি যখন লিখি, পেছন থেকে ল্যাপটপ অফ করে দেয়। তারপর বলে, দিস ইজ নট টাইম টু ওয়ার্ক, বাবা। এর মানে এখন আমাকে খেলতে হবে। আমরা খেলি শব্দ আর সংখ্যার খেলা। আমরা তিনজন। দ্বিতীয় মাঝেমধ্যে মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও করে। ওর কথায়, মুভি মেক করি, বাবা! আমি হাসি। ও আরও আঁকে, আবার আঁকে। দিস্তা দিস্তা কাগজ দুদিনে শেষ! আমরা আগের মতো শিল্পকলার মাঠে যাই না, টিএসসিতে না, বইয়ের দোকানেও না। দ্বিতীয়ও জানে, বাইরে ভয়ানক ভাইরাস। এই ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে আমাদের। করোনার কারণে আমরা ঘরবন্দী। এ ভাইরাস ঈদ কিংবা মায়ের কান্না বোঝে না!