করোনা নাকি অপুষ্টি ঘটাবে বড় অঘটন?
জাতিসংঘের ‘দ্য ইম্প্যাক্ট অব কোভিড ১৯ অন ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন’ জুন ২০২০–এর ব্রিফিং থেকে এটা স্পষ্ট যে পৃথিবীর অনেক দেশই খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টির অভাবে ভুগছে এবং আরও বেশি মাত্রায় ভুগতে যাচ্ছে। তাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, মৃত্যুর মিছিল করোনার কারণে বেশি বড় হবে নাকি অপুষ্টির কারণে?
উল্লেখ্য যে এ চিন্তা শুধু বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়, বরং তা হতে পারে উন্নত-অনুন্নত সব দেশের জন্যই, কেননা সঠিক পরিকল্পনার অভাবে পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেই ঘটে যেতে পারে চরম অঘটন। হতে পারে তা অনুদান দিতে দিতে ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত সরকারি অর্থব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে, হতে পারে দীর্ঘদিন সরকারের সাহায্যে চলা মানুষের কর্মের বাইরে থেকে কর্মের প্রতি অনীহার কারণে। হাত পেতে চলতে অভ্যস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়লে দেশ অচল হতে বাধ্য। তাই বলে হতাশ হয়ে হাত-পা ছেড়ে দিয়ে অসহায় বোধ করে লাভ নেই। বরং লাভ আছে অথবা সুযোগ আছে অগ্রিম ভাবনা দিয়ে ভবিষ্যৎ জয় করার।
একটা কথা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি অথবা বলে থাকি, ‘দুমুঠো খেয়ে–পরে বেঁচে থাকার জন্যই তো কাজ করছি’। এমনকি চুরি–ডাকাতি করে ধরা পড়ার পরও চোর-ডাকাতের কাছ থেকে পেটের জ্বালা মেটানোর পক্ষে এমন উত্তর এলেও আমরা থমকে দাঁড়াই।
ছোটবেলার সেই গল্পের কথাও নিশ্চয়ই মনে আছে অনেকের। রাস্তায় চোর চোর বলে সবাই যখন ছুটছিল চোরকে মারতে, তখন বাবার আঙুল ধরা ছোট্ট শিশুটি বলল, ‘বাবা আমি চোর দেখব’। অগত্যা বাবা শিশুটিকে ভিড় ঠেলে চোরের কাছে নিয়ে গেলেও শিশুটি ‘চোর’ খুঁজতে লাগল। সে আবার বাবাকে বলল, চোর কই বাবা? বাবা চোরের দিকে আঙুল দিয়ে বলল ‘ওই তো’। শিশুটির উত্তর ছিল, কই চোর! উনি তো মানুষ।
মানুষই চুরি করে, অন্য প্রাণীরাও হয়তো করে। মোট কথা হলো, ক্ষুধার তাড়নায় মানুষ কী না করে? তাই বলে মনে করবেন না যে আমি চুরির পক্ষে সাফাই গাইছি। তবে মানুষ যখন প্রাণনাশের আশঙ্কায় পড়ে অথবা প্রাণে বেঁচে থাকার জন্য আকুল হয়, তখন সে কী করতে পারে, তার তাজা নজির সেদিন আমরা দেখেছি কাবুল বিমানবন্দরে।
সব দেশে নিশ্চয়ই ভাবার মানুষ আছেন, ভাবছেন, কাজ করছেন। আমাদের দেশের জন্য ভাবনা চিন্তা করে উদ্যোগ নেবার অনেক পথ আছে বলেই মনে করি। হঠাৎ করে ব্যাংকে রেমিট্যান্স বাড়াতে আমি খুব আনন্দিত হতে পারিনি। কারণ, এটা ব্যাংকের জন্য সুখবর হলেও দেশের জন্য দিন শেষে কী হবে জানি না! অনেকেই বিদেশের তল্পিতল্পা গুটিয়ে কর্মহীন হয়ে দেশে ফেরার মানে কী, এটাও নিশ্চয়ই ভাবতে হবে।
আমাদের দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের পরিমাণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন অনেক নিয়মিত চাকরি করা মানুষ চাকরিচ্যুত হয়ে। সঙ্গে রয়েছে নানান রকম বিধিনিষেধ। দেশের বৃহৎ অংশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমতে থাকলে উৎপাদনও নিরুৎসাহিত হবে একসময়। উৎপাদন নিরুৎসাহিত হওয়া মানেই আরও মানুষের চাকরি হারানো। কাজ বা চাকরি হারানো মানুষের মিছিল যত বড় হবে, অপুষ্টি ততই জেঁকে বসবে। অপুষ্টি জেঁকে বসা মানেই শুধু করোনা নয়, যক্ষ্মা, নিউমোনিয়াসহ আরও নানাবিধ রোগে মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা।
এখন পর্যন্ত করোনা মোকাবিলায় ইমিউন সিস্টেমকেই সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। যে ইমিউন সিস্টেম ত্বরান্বিত করে পুষ্টি। যে কারণে অপুষ্টিজনিত ইমিউন সিস্টেমের কী হবে, সেটাই আজকের লেখার মূল প্রতিপাদ্য। টিকার সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে অনেক রকম মতবাদ উঠলেও, মানুষের শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধক্ষমতার কার্যকারিতা নিয়ে কোনো মতপার্থক্য কোথাও নেই। কাজেই করোনা-লকডাউন-অপুষ্টি এই ত্রিমাত্রিক সম্পর্ক আমাদের মাথায় থাকা খুবই জরুরি।
ডিম আর মুরগি নিয়ে সেই পুরোনো কথার মতো প্রশ্ন জাগে, করোনার কারণে অপুষ্টি বাড়বে নাকি অপুষ্টির কারণে বাড়বে করোনা?
*সৈয়দ মিজানুর রহমান, শিক্ষক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি